“বিদ্যাভুবন” সবাই দেখুক : নাদিম ইকবাল

By: রাশেদ শাওন ২০২০-০৫-২০ ২:৫৬:৩৪ পিএম আপডেট: ২০২৪-১২-৩০ ১২:০৪:০১ পিএম সাক্ষাতকার
বিদ্যাভুবন স্কুল
নাদিম ইকবাল
নাদিম ইকবালের ছবির পোস্টার
নাদিম ইকবাল
নাদিম ইকবাল
নাদিম ইকবাল, নাঈম, মামুন
নাদিম ইকবাল
নাদিম ইকবাল
ছবি শুটিংয়ের দৃশ্য
ছবি শুটিংয়ের দৃশ্য
নাদিম ইকবাল
আলোকচিত্রি ও নির্মাতা নাদিম ইকবাল

নাদিম ইকবাল। আলোকচিত্রি ও নির্মাতা। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। স্বপ্ন দেখতেন সিনেমা বানানোর। এই বিদ্যা রপ্ত করতে পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন পাশের দেশ ভারতে। পুনেতে। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়নি। ভাগ্যচক্রে পাড়ি দিলেন আরও দূরের পথ। এখন থেকে প্রায় সাত বছর আগে প্রবাসী হন উত্তর আমেরিকার অন্যতম দেশ কানাডাতে। তারপর থেকেই যেনো ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হল। তিনি ছবি তোলা শিখতে ভর্তি হলেন সেনেকা কলেজে। মোড় ঘুরে গেল জীবনের। একই প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পন্ন করেন ডকুমেন্ট্রি ফিল্মের উপর আরেকটি কোর্স। আর থামতে হয়নি। তাঁর প্রথম ছবি মাদার টাং দেশে-বিদেশে আলোচিত ও প্রসংশিত। ছবিটির ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতিও। 

সম্প্রতি তাঁর নির্মিত দ্বিতীয় ছবি বিদ্যাভুবন মুক্তি পেয়েছে অনলাইনে ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউবে। খবরের সূত্র ধরে গুণি ও পরিশ্রমী এই নির্মাতার সঙ্গে কথা বলে সুখবর টোয়েনটি ফোর ডটকম।  সেই আলাপচারিতা থেকে আজ শোনাচ্ছি আলো-আধাঁরের এক মুগ্ধ চিত্রকারিগর নাদিম ইকবালের বিস্তারিত।

 

রাশেদ শাওন: আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানলাম দ্বিতীয় ছবি মুক্তি দিয়েছেন। হঠাৎ কি মনে করে বিদ্যাভুবন রিলিজ করলেন?

নাদিম ইকবাল: সত্যি বলতে, করোনাকালিন সময়ে সকলেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ভাবলাম আমার ছবিটি দেখে অনেকের ভালো লাগতে পারে। তাই বিদ্যাভুবন’র মুক্তি দিলাম। তাছাড়া সম্প্রতি আমার জন্মদিনে স্কুলটির ছাত্রছাত্রীরা আমাকে চমকে দেয়। তারা হাতে হাতে আমার নামের একেকটি অক্ষর লিখে সবাই মিলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। আমি তাদের কর্মকাণ্ড দেখে আপ্লুত। ভাবলাম স্কুলটি নিয়ে আবার আলোচনা হোক। নর্থ আমেরিকানরা আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না বললে চলে। তাদের কাছে বাংলাদেশ মানেই অভাবগ্রস্থ্য, দুর্নীতিপরায়ন একটি দেশ। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। আমরাও মানবিক। আমাদের স্বপ্নগুলোও আকাশে পাখা মেলে। এঁরা ছবিটি দেখে অন্তত একটি গল্প সম্পর্কে জানুক।

 

রাশেদ শাওন: এটিতো আপনার দ্বিতীয় ছবি। এর আগেরটিতেও দেখেছি এক ধরণের ইমোশনাল চিত্রকল্প পুরো সময় ধরে দর্শক ধরে রাখে। এই ছবিটিও দেখার পর আমার মনে হয়েছে, একই ঘটনা ঘটছে। বিদ্যাভুবন, একজন দর্শককে ফ্রেম টু ফ্রেম আটকে রাখে অর্ন্তনিহিত ইমোশনাল টাচ দিয়ে। যা দর্শককে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে আমার মনে হয়েছে।

নাদিম ইকবাল: আমি পূর্বনির্ধারিত কোনো স্ক্রিপ্ট নিয়ে ছবিটি বানাইনি। মাদার টাং নিয়ে আমার পরিকল্পনা ছিল অনেক। তবে সেখানেও লিখিত কোনো স্ক্রিপ্ট ছিল না। এটা খুব কমন বিষয়। তবে আমার কাজে নিজের ভিতরের ইমোশনটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা থাকে। সেটা হয় অবচেতনে। এখানে কিছুই আরোপিত বা পূর্ব পরিকল্পিত নয়। তারপরও আমি অনেককে দেখেছি মাদার টাং দেখার পর তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিল না। 

আমার আরও একটি প্রডাকশনের কাজ চলছে। এর জন্যে আমি নোভাস্কোসিয়ায় যাই। সেখানে ৪ দিনের একটি সফর ছিল। কানাডার এই প্রোভিন্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অ্যাক্টিভিটিজগুলো এর উপজিব্য। এই ছবির শেষের দিকটাতেও ইমোশনাল নানা বিষয় ধরার চেষ্টা করেছি।

 

রাশেদ শাওন: সম্ভবত প্রতিটি কাজ সময় নিয়ে করেন আপনি। এই প্যানডেমিক সিচ্যুয়েশনের ভিতরেও কি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন?

নাদিম ইকবাল: এক সাথে একাধিক প্রজেক্ট চলছে। বিশেষ করে কবি আসাদ চৌধুরিকে নিয়ে তার বায়োগ্রাফিক্যাল একটি কাজ করছি। আমার সব ছবির সম্পাদনার কাজ নিজেই করি। তাই যেসব কাজ আগে ধারণ করেছি সেসব নিয়েও ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। এর আগে সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে একটি কাজ করেছি। দেখতাম এদেশের বয়স্ক সিটিজেনরা থ্যারাপিয়োটিক ড্যান্স করে। এদের কেউ কেউ আশির্দ্ধো। আমাদের দেশে যেখানে একজন মানুষ পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই মৃত্যূ চিন্তা নিয়ে মরিয়া হয়ে ওঠে, এখানে এঁরা নিজে গাড়ি চালাচ্ছে, সব কাজ নিজেই করছে, এমনকি ড্যান্সের মতো কঠিন শিল্পকে এমনভাবে নিজেদের জীবনের সাথে খাপখাইয়ে নিয়েছে যে একে তারা বলছে থেরাপি। তাদের সেই নাচের দৃশ্যের শুটিং করার সময় আমার মনে হয়েছে, যদি ভাবা যায় জীবন শেষ, তাহলে শেষ। কিন্তু জীবনের রঙ দেখতে চাইলে তা কিন্তু রঙিন।

আরও একটি প্রজেক্ট চলছে। বাংলাদেশের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায় নিয়ে। তাদের নিয়ে ডিটেইল একটা স্টোরি করছি। এছাড়া একটি ফিকশন প্রডাকশনের কাজও চলছে।

 

রাশেদ শাওন: একজন পেশাদার নির্মাতা হিসেবে কাজ করছেন প্রবাসে এসে। সেই জার্নিটা কবে, কিভাবে শুরু হল?

নাদিম ইকবাল: আগে থেকে প্রচুর সিনেমা দেখতাম। তখনও নির্মাতা হওয়ার বিষয়টি স্বপ্নই ছিল। আর একটা ঘটনা ঘটল ২০১২ সালে। সে বছর আমার ছেলের জন্ম। সে সময় আমার স্ত্রী বললেন, মেয়ের ভালো কোনো ছবি নেই। ছেলের বেলায় তা হবে না। তখন ডিএসএলআর একটা ক্যামেরা কিনি, সনি আলফা ৩৫০। তবে আগ থেকেই ফিল্ম করার স্বপ্ন ছিল। একবার ভারতের পুনেতেও যেতে চেয়েছিলাম। যাওয়া হয়নি। ২০১৩তে চলে এলাম কানাডাতে। আসার পর খোঁজখবর শুরু করলাম ফিল্ম নিয়ে কোথায় পড়ালেখা করা যায়। এর মধ্যে সেনেকা কলেজে ফটোগ্রাফির কোর্সে ভর্তি হই। সেখানে দুই বছরের কোর্সটা করতে গিয়ে ফিল্ম করার আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। আগের কোর্সটা শেষ করে একই প্রতিষ্ঠানে ডকুমেন্ট্রি ফিল্ম নিয়ে আরও একটি কোর্স করলাম। 

কোর্সটি করার সময় দেখলাম বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নেতৃত্বস্থানীয়রা টরোন্টোতে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগে বেশ দৌঁড়ঝাপ করছে। দেখতাম প্রায়ই স্থানীয় ও কেন্দ্রের গভর্নিং বডির সাথে দেনদরবার, মিটিং করছেন তাঁরা। আমি সেসবের ছবি তুলতাম এবং ভিডিও করতাম। সেইসব ফুটেজ দিয়ে চার মিনিটের একটি ছবি বানাই। নাম দিই আইএমএলডি (ILMD)। ছবিটি আমি স্কুলের একটি প্রজেক্ট হিসেবে জমা দিই। সেই প্রেজেন্টেশনে প্রায় ৬০-৬৫ জন দর্শক ছিলেন। এদের মধ্যে আমার শিক্ষক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই ছিলেন।

আমার সংগৃহীত ফুটেজগুলোর সাথে একটি ইন্ট্রো জুড়ে দিই। এতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল। এছাড়া ভাষার জন্যে মানুষের প্রাণ দেওয়ার কথা বলি। এবং ১৯৯৯ সালে ইউনিস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে সেটিও জুড়ে দিই। ছবিটি নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় আমি সামনে দাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করি উপস্থিত কেউ বিষয়টি জানে কিনা। খুবই হতাশ হই। নিজেকে অপমানিত মনে হয়। ভাষা নিয়ে এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা অথচ এঁরা কেউ তা জানে না। 

 

রাশেদ শাওন: আপনার প্রথম ছবি মাদার টাং। এই ছবিও কি সে সময় তৈরি করেন?

নাদিম ইকবাল: ফিল্ম মেকিংযের প্রথম ক্লাশে ইন্সট্রাক্টর বলেন, কোর্সের শেষে সবাইকে একটি করে চলচ্চিত্র ফাইনাল প্রজেক্ট হিসেবে জমা দিতে হবে। তখনই আমি ছবিটির চিত্রকল্প তৈরি করি। ক্লাসে আমি সেই শিক্ষককের কাছে জানতে চাই, বিমানবন্দরে কিভাব শুটিংয়ের অনুমতি পাওয়া যায়। সেদিন তিনি বুঝতে পারেননি যে সত্যিই আমি কোনো ছবির পরিকল্পনা করছি। ক্লাশে বসেই এই ছবির প্রথম ও শেষ দৃশ্য ভাবি। আমার ভাবনায় ছিল- প্রথিতোযশা কবি আসাদ চৌধুরির এদেশে আসা ও এদেশ থেকে ফিরে যাওয়ার দৃশ্যই হবে এর প্রথম ও শেষ দৃশ্য। কিন্তু মূল ছবিতে তার বিমানবন্দরে নামার দৃশ্যটি নেই। কারণ তিনি যেদিন আসলেন সেদিনের ফ্লাইটটি নির্দিষ্ট সময়ের ৪৫ মিনিট আগে এসে ইয়ারপোর্টে পৌঁছায়। তাঁকে যেখান থেকে ধরতে পারি সেখান থেকেই ছবিটির শুরু। 

 

রাশেদ শাওন: আপনি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হাতেকলমে শিখে নির্মাতা হয়েছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রায় সকলেই এখনও সিনিয়রদের কাছ থেকে শিখে সিনেমা বানাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন নির্মাতা হয়ে ওঠা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

নাদিম ইকবাল: অভিজ্ঞতার গুরুত্ব অবশ্যই আছে। আবার স্বপ্নও দেখতে হবে। আমারা বন্ধুরা মিলে একবার নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেসসময় আমার এক বন্ধু একটি পাহাড়ে আমার পাশ দিয়ে হাঁটছিল। আমি তৎক্ষণাৎ একটি দৃশ্য কল্পনা করে ফেললাম। তখন কিন্তু আমার দৃশ্য দেখা, বানানো, ক্যামেরার এ্যঙ্গেল এসবের কিছুরই ধারণা ছিল না। তবে স্বপ্নটা ছিল মনে। সেই স্বপ্ন একদিন কানেকশন তৈরি করে দিল প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে। সত্যি বলতে কি স্বপ্ন অনেকের মনেই থাকে। অল্প বয়সে তা ডালপালা মেলে। কিন্তু তাকে বাড়তে না দিলে, চর্চা না করলে একদিন তা মরে যায়। আবার এর চাষ করলে তা মহিরুহে পরিণত হয়। আমার কথাই ধরুন না, ঢাকার পরে এখানে আসার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাকে ট্রাকে নিয়ে গেল। 

সেই বিবেচনায় আমি যদি স্কুলে না যেতাম আমার স্বপ্নটাও নষ্ট হয়ে যেত। আর আগের ফিল্মমেকাররা যেভাবে আসতেন সেটি সেসময়ের সাথে ছিল। এখন সময় বদলে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমি আমার আরও একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। আমার বন্ধু নির্মাতা শাহিন দিলনেওয়াজ। তারও স্বপ্ন ছিল, চলচ্চিত্র নির্মাতা হবে। সেই স্বপ্নের পথ ধরে একদিন পাড়ি দিল জার্মানিতে। সেখানে এ বিষয়ে পড়াশোনা করল। এর মধ্যে দিয়ে তার স্বপ্নটারও একটা আউটপুট এল। 

 

রাশেদ শাওন: এবার শুনতে চাই বিদ্যাভুবন’র কথা। এই ছবিটি নির্মাণের গল্প শুনতে চাই।

নাদিম ইকবাল: ২০১৭ সালে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে গেলাম। আমার বাল্য বন্ধু নাঈম আহমেদ কিবরিয়ার লালমাটিয়ার অফিসে নিয়মিত আড্ডা দিই। একদিন আড্ডা দিতে দিতে নাঈম জানালো মামুনের কথা। সে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্যে নিজের কিনডি বিক্রি করবে। সে আমাকে কিছু ছবি দেখায় স্কুলটির। সাথে সাথে আমি সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করি। সেখানে আরেক বন্ধু ঢাকায় চারুকলার শিক্ষক নাসিমুল খবীর ডিউকও উপস্থিত ছিল। সেও যেতে চায়। আমরা তিন বন্ধু মিলে ময়মনসিংহের নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পরিকল্পনা হয়- একদিন মামুনের গ্রামটিতে থাকব। এর পরের দিন চলে আসব। সেখানে পৌঁছার পর আমরা স্থানীয়ভাবে তৈরি অটোতে চেপে বসলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গ্রামে যাওয়ার পথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ব্যাঙ ডাকার শব্দে পুরো পথ বিমোহিত ছিলাম। এভাবে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম কাছিয়াকান্দি গ্রামে।

সেখানে গিয়ে মামুনকে পেয়ে গেলাম। আমরা যে ঘরটিতে ছিলাম তার ছাদে মামুনকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তার কথা শুনতে লাগলাম। আমার বন্ধু নাঈমকে বললাম লাইট ধরতে আর ডিউক সাহায্য করল সাউন্ড ধারণ করতে। বৃষ্টি হচ্ছিল সে সময়। আমরা সবাই ভিজে যাচ্ছিলাম। তবে মামুন বলছিল তার স্বপ্নের কথা। আর আমরা তা ধারণ করছিলাম ক্যামেরায়। এর পর আমাদের ফেরার কথা ছিল এক সাথে। তা হল না। ডিউক ঢাকায় ফিরলো নির্ধারিত দিনে। আমি আর নাঈম থেকে গেলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল মামুনের বাসার লিভিং রুমে। তাঁর বাড়িটা স্কুলের সাথে লাগোয়া। জানালা দিয়ে স্কুল দেখা যায়। স্কুল শুরুর সময় পৌনে নয়টা। কিন্তু ছোট ছোট শিশুরা স্কুলে আসত সকাল আটটারও আগে। সেসব দৃশ্য ধারণ করতে করতে আমি যেনো সবকিছুর মধ্যে ডুবে গেলাম। টানা দশদিন শুটিং করলাম প্রথম দফায়।

 

রাশেদ শাওন: তার মানে আপনি কি এরপরেও স্কুলটিতে শুটিং করেছেন?

নাদিম ইকবাল: দুইবার যাই। এই যাওয়া আসার মাঝে কত যে ঘটনা ঘটে! একটি ঘটনা আমার জীবনের সাথে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে গেল। শুটিং তখন শেষের দিকে। সন্ধ্যাবেলা। আমরা বসে আছি বাঁশের মাঁচায়। মামুনের বউ চা নিয়ে এল। সেদিন পূর্ণিমা ছিল। আকাশ ভরা জোৎস্না। জোনাকির আলোও ছিল। সেসময় দূরে একটি বাড়িতে কূপিতে আলো জ্বলছিল। একেই বুঝি বলে অপার্থিব সৌন্দর্য্য। প্রকৃতির এই অপার রূপ উপভোগ করতে করতে হঠাৎ দূরের কূপিটি নেভানোর কথা বললাম আমি। কেউ একজন তা শুনে দৌড়ে গিয়ে বাতিটি নিভিয়ে দিয়ে এল। তখন অভ্যাসবশতঃ হঠাৎই কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেললাম। মালুম হল, আমি সিগারেট ধরিয়েছি, যা সেই পরিবেশে ছিল অমার্যনীয় অপরাধ। পুরো পরিবেশের সাথে যা কোনোভাবেই যায় না। আমি যে সিগারেটটি নিভিয়ে মাটিতে ফেলব সেটিও পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল চারপাশ আর প্রকৃতি আমার এই কাণ্ডটিকে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। সেদিনের সে ঘটনা আমার মনে দগদগে ক্ষত তৈরি করল। টরোন্টোতে ফেরার পরও তা ভুলতে পারছিলাম না। তবে একটা উপকার হল আমার। এর পর থেকে আজও আর সিগারেট ধরিনি আমি।

 

রাশেদ শাওন: এই ছবির প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় তিনজন নারী ধানেরক্ষেতের আলপথ ধরে লম্বালম্বি হেঁটে যাচ্ছে বাম থেকে ডানে। তারা কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায় একটি কুকুর ফ্রেমে প্রবেশ করে। সেও তাদের পিছুপিছু এগোতে থাকে। নারী তিনজন ফ্রেমের ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর কুকুরটি ঠিক মাঝপথে এসে দিক বদলিয়ে ডানদিকে ঘুরে যায়। ঠিক ক্যামেরার মুখ বরাবর হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসে। আপনার ক্যামেরা তখনও সরে না তার অবস্থান থেকে। যতক্ষণ না কুকুরটি ফ্রেম থেকে বেড়িয়ে যায় ততক্ষণ আপনার ক্যামেরা স্থির থাকে। দেখে মনে হয় আপনার নির্দেশনা মেনে প্রাণীটি শট দিয়ে বেড়িয়ে যায়।

নাদিম ইকবাল: আমি বলব, ফিল্মমেকাররা সবসময় প্রকৃতির সাহায্য পায়। ছবিতে কুকুরটি ছিল আমার জন্যে উপরি পাওনা। সত্যি সে এই ছবিতে একটি চরিত্র হয়ে ওঠে। সে যেনো স্কুলটির শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, প্রতিবেশের সঙ্গে একটি অবিচ্ছেদ অংশ। পোষা কুকুরটির ওরা নাম দিয়েছিল ট্রাম্প। এই ট্রাম্প অবশ্য আততায়ীর হাতে খুন হয়। প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে আমার ছবিটির দৃশ্য ধারণ শেষে কয়েকদিনে পর হত্যা করে তাকে।

 

রাশেদ শাওন: এমন একটি ছবি উৎসবগুলোতে জমা না দিয়ে ইউটিউবে উন্মুক্ত করে দিলেন কেন?

নাদিম ইকবাল: এর আগে ২০১৮ সালে ঢাকা লিট ফেস্টে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া কানাডার নামকরা ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ছবি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ছবিটি মেক্সিকোতে আমন্ত্রিত হয়েছে। যারাই দেখেছে তারাই কাছিয়াকান্দি গ্রামে যেতে চেয়েছেন। এখন চাইছি, বিদ্যাভুবন সবাই দেখুক। এই প্রত্যাশা থেকে ছবিটি মুক্তি দিয়েছি।

 
রাশেদ শাওন: ছবিটি উপভোগ্যই বটে। অন্যরাও এটি দেখুক। আর আপনার সুসাস্থ্য ও সাফল্য কামনা করছি। 
সুখবর অনলাইনকে সময় দেওয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।

নাদিম  ইকবাল: আপনাকেও ধন্যবাদ। সুখবর’র জন্যেও শুভকামনা। 

 

ছবিটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে