- ● যেভাবে ‘টেসলা’য় কর্মরত বাংলাদেশের রাফা
- ● A Decade of Recitation Elegance: Bachonik Celebrates 10 Years of Artistic Brilliance
- ● বর্ণাঢ্য আয়োজনে বুয়েট নাইট অনুষ্ঠিত
- ● ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’-এ ভূষিত বঙ্গবন্ধু
- ● শনিবারের কলমে হিমাদ্রী: মায়ের “শেখসাব”
- ● সুখী দেশের তালিকায় কানাডা ১৫তে, শীর্ষে ফিনল্যান্ড
- ● গিনেস বুকে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’
- ● দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দশ তরুণ নেতাদের তালিকায় মাশরাফি
- ● ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ২০২১ পাচ্ছেন যারা
- ● প্রসংশায় ভাসছে জিয়া হাসানের সাথে ঘরোয়া’র স্বত্বাধিকারীর আলাপচারিতা
“সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রমিথিউস কামাল লোহানী”
কামাল লোহানী সেই বিরল বাতিঘরদের একজন; যিনি মানুষের মুক্তির জন্য সতত সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছেন। একাত্তরের আগে; একাত্তরে, একাত্তরের পরে; কামাল লোহানী মুক্তির লড়াইয়ের রণক্ষেত্র ত্যাগ করেননি; পতাকা-মানচিত্র-ভৌগলিক স্বাধীনতাকে মানুষের যাপিত জীবনে পৌঁছে দিতে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।
তিনি সেই বিরলপ্রজ আইকনদের একজন; যিনি কোন দলীয় উত্তরীয় পরে বিশ্রামে চলে যাননি। পাকিস্তান সরকারের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে; সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে সাংস্কৃতিক সংগঠনের দুর্গ গড়েছেন। বাংলাদেশ কালেও প্রমিথিউসের মতো আলোর আগুন নিয়ে সংস্কৃতি অঞ্চলে সতত সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকের তরুণদের তিনি যেমন প্রাণিত করেছেন; একই ভাবে একবিংশের তরুণদের উদ্দীপিত করেছেন।
নব্বুই দশকে শাহবাগের মুক্তাঞ্চলে, পাবলিক লাইব্রেরি-জাতীয় জাদুঘর-বাংলা একাডেমির মানুষের ভিড়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা একজন দীর্ঘদেহী মানুষকে দেখা যেতো; বাংলাদেশ চেতনার আলোর মশাল নিয়ে ঘুরছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দ সৈনিক সাজাহান ফারুক, আবদুল্লাহ আল ফারুক বন্ধুদ্বয়ের কাছ থেকে কামাল ভাইয়ের নামটি শোনা যায়; যিনি হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রকে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত করেছিলেন। সি এস পি পরীক্ষায় না বসে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে ও সতত সক্রিয় থাকতে এই দু'জনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি। তাইতো তারা পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকিতে রেখে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন; মিডিয়া যে মুক্তির সংগ্রামে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারে; সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে সশস্ত্র আন্দোলনের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী; আর সততা যে জীবনানন্দের জ্বালানি; এটা কামাল লোহানী সে সময়ের তরুণদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন; নিজের যাপিত জীবনে তা সতত চর্চার মাঝ দিয়ে।
কামাল লোহানীর খদ্দরের পাঞ্জাবী তার স্বদেশ চেতনা, "কখনো বদলে না যাওয়া মানুষে'-র ঋজু চিহ্ন। ক্ষমতা কাঠামোর "বুলবুলি আখড়াই"-এর চেয়ে তারুণ্যের অক্সিজেন ভরা পথ নাটক কিংবা সড়কদ্বীপের সাংস্কৃতিক আয়োজন টেনেছে তাকে বেশি। তাইতো কবি ও কথা সাহিত্যিক মুজতবা আহমেদ মুরশেদের বর্ণনায়, চোখের তারায় ঝিলিক দেয়া স্বপ্ন দ্যোতনার মাঝে আবার কামাল ভাইয়ের গল্প শুনতে পাই। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রমিথিউস কামাল ভাই। এইভাবে কামাল ভাই পাকিস্তানকাল ও বাংলাদেশকালে; একই যুদ্ধের প্রান্তরে থেকে যান। তিনিই সেই অনির্বাণ; যাকে একাকী করে সহযোদ্ধারা ক্ষমতার রঙ্গভবনে রুলিং এলিট সেজে পিঠাপুলি খেতে গিয়েছেন।
কিন্তু কামাল লোহানীর মেরুদন্ড অনমনীয় ঋজুতায় চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত হ্যাভস-নটদের পাশে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। নাগরিক সমাজের আইকন কেমন হওয়া উচিত; এই প্রশ্নের উত্তর কামাল লোহানী।
নিজের জীবনে “সংখ্যা-লঘু”-র বেদনা উপলব্ধির যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো; তা কখনো ভোলেননি তিনি। তাই দক্ষিণ এশিয়া বিভাজনের পরে; বাংলাদেশের “সংখ্যালঘু”-র নিরাপত্তা হতে চেয়েছেন জীবনব্যাপী। অন্যধর্মের মানুষ কতৃক একটি ভৌগলিক সীমানায় নির্যাতিত হয়ে; তিনি তাদের প্রতি কোন বিদ্বেষ পোষণ করেননি। বরং অন্য একটি ভূগোলে তাদের আঁকড়ে ধরেছেন আত্মীয়ের মতো। তিনি যে ভালোবাসার মানুষ; বিদ্বেষের কথাকলির আসরের প্রতিশোধ প্রবণ গড়পড়তা চিন্তার মানুষ যে তিনি নন। ঘৃণা নয় ভালোবাসার শক্তি যে অপরিমেয়; কামাল লোহানী একটি পুরো জীবন মানুষকে ভালোবেসে তা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
কামাল লোহানী রাজ বিদূষক হবার জন্য জন্মাননি; তিনি সোনালি প্রান্তরের “ক্রান্তি”-কালের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। নয়মাসে তার যুদ্ধ ফুরায়না; নবজাগরণের স্বপ্নহানা এই মানুষের মুক্তির সেনাকে তাই কখনোই গার্হস্থ্য খাঁচায় কিংবা সুফল কুড়ানোর সোনার খাঁচার আশেপাশে দেখা যায়নি।
এরকম একজন শিক্ষিত ও যোগ্য মানুষ; যিনি সাংবাদিকতার সোনালি যুগের নক্ষত্র; তিনি স্পন্সরের কাছে নতজানু সম্পাদকীয় নীতির মিডিয়া; কিংবা সরকারি বাতাবি লেবু মিডিয়ার কর্তাব্যক্তি হয়ে জনগণকে ঠকানোর গণযোগাযোগে যাননি; তিনি বরং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মুক্ত যোগাযোগে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে ঘুরেছেন।
আশির দশকের শেষদিকে রাজশাহী থেকে কোচে করে আসার সময় আমার সামনের সিটে দেখি কামাল লোহানী। অনেকটা পথ; মাঝে ফেরি পারাপার; তাই অনেক গল্পের সুযোগ। আপাত দৃষ্টিতে রাশগম্ভীর এই মানুষটির সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলতে যাবার সাহস ছিলো না। এ রকম চেহারার মানুষেরা লেখাপড়ার প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিয়ে বসে যান। এইচ এস সি পরীক্ষায় রসায়নে খুব খারাপ নম্বর আসায় আমার মন তখন খারাপ। সঙ্গে নম্বরপত্র আছে; উনি যদি পরিচয় হবার পরেই ওটা দেখতে চান; এই অমূলক ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম আমি।
পরে উনি নিজে থেকেই কথা বললেন। প্রতিটি বাক্য; তার মধ্যে সাজানো শব্দ; খুব সাধারণ কথা; কিন্তু অভিনব তার প্রক্ষেপন। এতো দীর্ঘ এই রাজশাহী থেকে ঢাকা যাত্রা; এ যেন এক ম্যারাথন ক্লাস লেকচার শোনার উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ালো। না তিনি এইচ এস সি-র রেজাল্ট নিয়ে বিচলিত করেননি। বরং ফেরির ওপরে বসে কোচ ড্রাইভারকে বললেন, মান্না দে'র গান তো অনেক শোনা হলো; এ ছেলেটি বোধ হয় হিন্দি গান শোনার জন্য অস্থির; একটু তা-ও বাজান।
এরপর কেয়ামত সে কেয়ামত তাক ছবির তুম ভি আকেলে হামভি আকেলে মজা আ রাহা হ্যায় গানটি শুরু হলে উনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, না-ও দিলাম তোমার পছন্দের গান বাজিয়ে।
আজ উনি যখন চলে গেলেন, তখন আমার জন্য রেখে গেলেন কামাল লোহানীর সঙ্গে একদিনের স্নেহ ভরা রসায়নের স্মৃতি। আলো এমনই হয়; সহস্র মাইলের দূরত্বেও তা পৌঁছে দিতে পারে; হারানোর বেদনা; প্রাপ্তির আনন্দ, মিডিয়া মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা।
মাসকাওয়াথ আহসান: লেখক ও সাংবাদিক।