‘মনের আঙিনায় আমাকে রোজই দেখতে পাবি’

By: ফারহানা মিলি ২০২০-০৬-১৬ ৭:৫৬:৩৬ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-২৯ ১২:২০:৫১ পিএম মতামত
সুশান্ত সিং রাজপুত

বলিউডের সুদর্শন প্রতিশ্রুতিশীল তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর খবরটি দেখলাম পশ্চিমা পত্র-পত্রিকায় ঠাঁই পেয়েছে। ‘ব্লুমবার্গ’ ও ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ খবরটি এসেছে। এক মাসেরও বেশি আগে ক্যান্সারের কাছে হার মানা ৫৩ বছর বয়সী ইরফান খানের মৃত্যুর খবরটিও পশ্চিমের সব গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। কারণ তিনি হলিউডের মূলধারার অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেগুলোর কোনোটি বক্স অফিসে তোলপাড় তোলা; কোনোটি অস্কারে বা অন্য উৎসবে পুরস্কৃত।

‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’, ‘লাইফ অব পাই’, ‘দ্য অ্যামেজিং স্পাইডারম্যান’, ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’-এর মতো ছবির অভিনেতা তিনি। চরিত্রগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এইচবিও-এর একটি ড্রামা সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন ইরফান। নাটালি পোর্টম্যান ও টম হ্যাঙ্কসের মতো তারকারা ইরফানের কো-স্টার হয়েছেন।

আবার ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবি; পেয়েছে ব্রিটেনের সম্মানজনক বাফটা অ্যাওয়ার্ড। তিনি নিজে আমেরিকার স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ‘স্লামডগ মিলিওনার’ ছবির জন্য— অন্য কো-আর্টিস্টদের সঙ্গে মিলে। ফলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিনেতা হিসেবে তিনি সেখানে খানিকটা পরিচিত মুখ।

ইরফানের সঙ্গে দুদিনের ব্যবধানে একসময়কার জনপ্রিয় নায়ক ৭৩ বছরের ঋষি কাপুর মারা যান। বলিউডের ‘এক নম্বর পরিবার’ বলে তাঁর পরিবারকে মনে করা হয়। কারণ এই কাপুর খানদানের হাত ধরেই বলতে গেলে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ। কয়েক প্রজন্ম ধরে এই পরিবারের সদস্যদের এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ততা ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করেছে। কারণ কাপুরদের একটা বড় গুণ হল, ওরা অভিনয় শিখে নেন, পরিশ্রমও করেন। স্বজনপ্রীতি করে উপরে ওঠেন না।

যাহোক, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই ‘চকলেট হিরো’ ঋষিরও ছিল। কিন্তু নবীন প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচিতি কেবল ‘রণবীর কাপুরের বাবা’ বা ‘কারিনা কাপুরের চাচা’। ইরফানের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিও তাঁর ছিল না। তাই বিশ্বমিডিয়ায় তাঁর মৃত্যুর খবরটি দেখিনি।

সুশান্ত সিং রাজপুতের অকালমৃত্যুর জন্য অশ্রুসিক্ত বলিউডের পাশাপাশি পশ্চিমের গণমাধ্যমে আলোচনার কারণ হতে পারে একটাই-- এখনকার বলিউড তারকারা ইউরোপে ও আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা নবীন ভারতীয়দের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। অনাবাসী ভারতীয়দের কাছে সুশান্তের ঘটনাটি খুবই বেদনাবহ হয়ে এসেছে। খবরটি তাই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে নানা মিডিয়া।

সুশান্ত যেভাবে দ্রুত চলে গিয়ে সবার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিলেন, তেমনটা ঘটেছিল নব্বই দশকে প্রয়াত দিব্যা ভারতীর বেলায়। টিনএজ বয়সে সিনেমায় ঢুকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিরাট খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলেন বছর বিশ-কী-বাইশের এই তরুণী। ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে থমকে গিয়েছিল বলিউড। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তখন আমাদেরই মতো বয়সী বার্বি ডলের মতো অপরুপা মেয়েটি এক বিকেলে নিজ বাড়ির ব্যালকনি উইন্ডো থেকে পড়ে মারা গেলেন।

 

                             বলিউড অভিনেত্রী প্রয়াত দিব্যা ভারতী

সুশান্তর মৃত্যু যেমন কিছু প্রশ্ন আর রহস্যের জন্ম দিয়েছে, দিব্যার বেলায় তাই ঘটেছিল। ভক্তরা এত বছর পরও একে স্বাভাবিক মৃত্যু (দুর্ঘটনাজনিত) বলে মেনে নিতে পারেননি। বিতর্ক উঠেছিল বলিউডের সিনেমায় ভিনদেশে থাকা মাফিয়াদের প্রভাব নিয়ে। মাফিয়ারাই দিব্যাকে কৌশলে খুন করিয়েছে এমনটা বিশ্বাস করেন অনেকে। কোনো কিছু মাফিয়াদের মনমতো না হলে তারা যে বড় কোনো তারকার ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে বা এমনকি তাকে মেরেও ফেলতে পারে এটা বলিউডেই চাউর ছিল।

এ প্রসঙ্গেই তখন মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের কথা আলোচনায় এসেছিল। নব্বই দশকে তার ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএ-এর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা শোনা যেত। সম্প্রতি দেখলাম, স্ত্রীসহ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দাউদ পাকিস্তানের একটি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। দুনিয়াজুড়ে মানুষের ওপর তাণ্ডব চালাতে পারলেও ক্ষুদ্র অদৃশ্য প্রাণির কাছে আমরা সবাই কী-যে অসহায়!

সুশান্ত যেমন নবীন সিনেভক্তদের বিশেষ করে কিশোরী আর তরুণীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন অল্প সময়ে, তেমনি আমাদের প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের স্বপ্নের রাণী হয়ে উঠেছিলেন গোলগাল চেহারার দিব্যা ভারতী।

তাই বলে তরুণীদের কাছে দিব্যার জনপ্রিয়তা কম ছিল না-- যেভাবে সুশান্তও তরুণদের কাছে সমান প্রিয়। পুরুষ ভক্তদের কাছে সুশান্তের প্রিয় হয়ে ওঠার কারণ খুব সম্ভবত তাঁর অভিনীত ‘এমএস ধোনি; দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ ছবিটি। ক্রিকেট-তারকা এম এস ধোনীর জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনি আবর্তিত। ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রেমিকার মৃত্যুতে মুষড়ে পড়ে খেলায় মনোযোগ হারিয়েছিলেন ধোনী।

 

                                                             সুশান্ত সিং রাজপুত

 

ছবিতে চরিত্রটি পুরোপুরি ফুটিয়ে তুলতে ক্রিকেটের আরেক তারকা কিরণ মোরের কাছে ক্রিকেট-বিষয়ক কোচিং করেছেন সুশান্ত। পর্দায় ধোনীর অনুকরণে তাঁর ব্যাটিং স্টাইল দেখে স্বয়ং ধোনী তাঁর খুব প্রশংসা করেছিলেন।

বোঝা যায়, পেশার প্রতি কমিটমেন্ট ছিল সুশান্তর। তা নাহলে বলিউডের বিশাল প্রতিযোগিতার জগতে নবীন প্রজন্মের বড় তারকা হতেও পারতেন না। স্বজনপ্রীতির যে বিরাট দৌরাত্ম্য চলছে ওখানে। সুশান্তের মৃত্যুর পর ভারতে তাই আঙুল উঠেছে সাম্প্রতিক এই প্রবণতার দিকেই। তারকা-সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন ঘরানা তৈরি করে তাদেরকেই তারকা বানিয়ে তোলার মিশন চলছে এখন। গত বিশ বছরে এই প্রবণতা এত নোংরাভাবে বলিউডকে দখল করেছে যে, এই শিল্পের বাইরের ছেলেমেয়েরা অসম এই লড়াইতে প্রায়ই টিকে থাকতে পারছেন না। আর যারা টিকে থাকছেন তাদের বেশিরভাগই কোনো-না-কোনো ঘরানার ধামাধরা হযে থাকছেন।

নিজেদের ঘরানার না হলে বা তারকা-সন্তান নয় যারা, তাদের একটা পর্যায়ে ছুঁড়েও ফেলে দেয় বলিউড। একজন শিল্পীর যত বড় অবদানই থাকুক না কেন, নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হলে স্বজনপ্রীতির মাফিয়ারা এমন ভান করে যেন এই শিল্পীকে তারা চেনেই না।

হ্যাঁ, ‘নেপোটিজম-মাফিয়া’ বলে এদের এখন ডাকা হচ্ছে। সত্যিকারের মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্য পরিস্থিতিটা সত্যিই বেদনার। মেধা আর শ্রম দিয়ে উঠে আসা স্বপ্নচারী তরুণ সুশান্তও তাই শেষ পর্যন্ত লড়াইতে হেরেই গেলেন। শৈশবে মাকে হারানো সুশান্ত মায়ের কাছেই শিখেছিলেন, ‘যা-ই ঘটুক আমরা টিকে থাকব’। সেটিও আর মনে রাখেননি তিনি।

কিন্তু যে বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেননি বা বুঝলেও আর ধৈর্য রাখতে পারেননি তা হল, তরুণ বলিউড-ভক্তরা তাঁকে মনে ঠাঁই দিয়েছিল। এই ভালোবাসায় ভর করে একটা লড়াই হয়তো করতে পারতেন কিনা কে জানে। ‘এমএস ধোনী: দ্য আনেটোল্ড স্টোরি’ সিনেমার একটি গানের শুরুর দিকের একটা লাইন এরকম— ‘তেরি দিল কি গলিয়োঁ সে ম্যায় হর রোজ গুজারতি হ্যায়’। বাংলা করলে দাঁড়ায়— ‘তোর মনের আঙিনায় আমাকে রোজই দেখতে পাবি’।

কথাটা যেন তাঁর ভক্তদের জন্য সত্য হয়ে গেল।

দিব্যা ভারতীর কথা বলছিলাম। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব আবাসিক হলে ডিশ অ্যান্টেনা চলে এসেছে। আমরা জিটিভি দেখতাম। দিব্যার মৃত্যুর পর প্রথা ভেঙে ওরা বারবার খবরটি প্রচার করছিল আর শাহরুখ-দিব্যা অভিনীত ‘দিওয়ানা’ সিনেমায় দিব্যার দুর্দান্ত নাচটি দেখচ্ছিল। ‘তেরা নাম রাখ দিয়া’ (তোর নাম রেখে দিলাম) গানের তালে কোঁকড়ানো চুল ঝাঁকিয়ে ওর নাচ দেখে খুব কষ্ট লাগছিল।

একজন দিব্যা-ভক্ত হিসেবে বুঝতে পেরেছিলাম, সত্যিই তিনি তাঁর নামটি রেখে গিয়েছেন— যেমন করে সুশান্তও তাঁর ভক্তদের হৃদয়ের গলিতে রোজ হানা দেবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন।

 

ফারহানা মিলি : সাংবাদিক।