গল্প: ফেরারী বাতাস এবং হারানো কলকব্জা

By: পারভেজ চৌধুরী ২০২০-০৬-১৯ ১১:৪১:৩৮ পিএম আপডেট: ২০২৪-০৩-২৯ ৩:৪৯:০৫ এএম সাহিত্য
আলো ঝলমলে রাতের টরোন্টোতে স্মৃতির মুখচ্ছবি

একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ধূসর বিকেলের আকাশটা এখনও মেঘলা। একা একা বসে আছি ব্যালকনিতে। ফেরারী বাতাসে বারবার দুলে উঠছে পাইন গাছগুলি। একটা ফোন কল আসছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি কোন নাম নেই, প্রাইভেট নাম্বার লেখা। কখনো কেটে দিচ্ছি। কখনো ধরছিনা, শুধুই রিং বাজছে। মনটা থেকে থেকে অকারণে খারাপ লাগছে। কি করলে ভালো হবে বুঝতে পারছিনা। আবার সেই একই ফোন কল। রিসিভ করতেই ভরাট কন্ঠে

: কই তুমি?

: বাসায়

: নিচে নামো, মিয়া

এরকম একটা কিছু চাইছিলাম। রেডি হয়ে এক নিমিষেই পার্কিং লটে নেমে আসি। চোখ ঈশারায় গাড়ীতে উঠতে বলেন। গাড়ীতে বসে সিট বেল্ট বাধতে বাধতে জিজ্ঞেস করি

: যাবো কোথায়?

এক হাতে ড্রাইভিং করতে করতে অন্য হাতের আঙ্গুলে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে

: হি স্ স !

এর মানে হলো চুপ! একদম চুপ! কোন কথা বলা যাবেনা। গাড়ীটা অলস ভঙ্গিতে এগিয়ে চলছে। কেউ যেন বিষাদ মেখে রেখেছে পুরো টরন্টো শহরে। নিজের জারী করা নিরবতা নিজেই ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করে

: জাহাঙ্গীরনগরে তুমি কোন ব্যাচের?

: নাইনটিনথ

: আপনি?

: ফিফথ ব্যাচের

: আপনি আর আনু মুহাম্মদ স্যার কি একই ব্যাচের?

: হ মিয়া, আনু আছিলো বইল্যা বাইচ্যা গেছি। আমি তো ওর নোট পইড়্যা পাশ করতাম।

বলে অদ্ভূত সুরে, বেসুরো গলায় গান শুরু করে

উয়ি আম্মা, উয়ি আম্মা।
উয়ি আব্বা, উয়ি আব্বা।।

কখনও খুবই ফুরফুরা মেজাজ, আবার কখনও ডিপ্রেসড মনে হচ্ছে। খুবই সুয়িং মুড । আমার সাথে আগে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, আড্ডাও হয়েছে কিন্তু এরকম খুটিনাটি, বিস্তারিত আলাপ হয়নি কখনও। গান শেষ করে

: ইকনোমিক্সের আর কে কে আছে টরন্টোতে?

: ফরিদ আছে মিসিসগায়। তুষার, হাকিম, মীম আর ময়না ভাই। আমি জানি এইটুকু আরও অনেকেই আছে…

: তোমাদের ব্যাচের ঐ পোংটা দুইটার নাম যেন কি?

: কাঞ্চন। পিকলু।

: হ হ। জিনিস দুইটা । বাপরে বাপ!

 

ড্রাইভ করতে করতে একটা পার্কে চলে আসি। পার্ক তো নয় যেন শতবর্ষী আচীনবৃক্ষের গহীণ জঙ্গল। নাম না জানা পাখির কিচির মিচির। বনফুলের গন্ধে ভরপুর চারপাশ। মেঘাচ্ছন্ন বিকেল কেমন যেন গুমোট গুমোট ভাব। এই পরিবেশে আপনা আপনি মন ভারী হয়ে আসে আকাশের মতো। অবশ্য আকাশের সাথে মানুষের মনের অদ্ভূত মিল আছে। চারপাশে তাকিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুন ধরায় কিন্তু হাতের মুঠোয় তা লুকিয়ে রাখে

: মনটা খুব খারাপ লাগছে, বিকেলটা কেমন যেন …

: আমারও।

: কি করবো বুঝতে পারছিনা। এখন তো হলে গিয়ে নাটকও দেখতে পারবো না। আজ ডাউনটাউনে একটা ভালো নাটক ছিলো।

: তাহলে চলেন বারে যাই

: নাহ! আজকাল খুব একটা ড্রিংকস করি না। বলা যায় ছেড়েই দিয়েছি। শরীররটাও ভালো যায়না…

: আরে ধুর! চলেন। একদিনে কিছু হবেনা।

: যাবা? চলো। মনিশ, টুকু, বনি আর ময়নারে ফোন দাও।

 

চোখ গোল গোল করে চারপাশে তাকিয়ে কি যেন দেখে আমার দিকে, এমন লুক দেয় যেন আমি একটা চোর। সবকিছু তাঁর কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যাব এক্ষুনি। আধা টানা সিগারেট মাটিতে ফেলে এক পায়ে পিষতে পিষতে

: উঠো গাড়ীতে । আমি শাওয়ার নিয়ে বের হবো। বেশী সময় লাগবেনা।

আমরা ক্যাবেজ টাউনে পৌছাই। টরন্টো শহরের এই ঐতিহ্যবাহী পাড়ার নামাকরণের পেছনে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা আছে। সময়টা আঠারো শতক। তখন এই পাড়া টরেন্টো শহরের বাইরে ডন ভ্যালীর একটি গ্রাম। সেখানে আয়ারল্যান্ড থেকে আসা স্বল্প আয়ের অভিবাসীরা বসবাস শুরু করে। সংসারের কিছুটা স্বচ্ছলতার জন্যে প্রতিটি বাড়ীর সামনে এবং পেছনের উঠানে দলে দলে ক্যাবেজ মানে বাধাঁকপি চাষ শুরু করে । সেই থেকে এই জনপদের নাম হয়ে যায় ক্যাবেজ টাউন। টরেন্টো শহরের বর্তমান এই ক্যাবেজ টাউন উত্তর আমেরিকার ভিক্টোরিয়ান বাড়ীর সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত এলাকা। সময়ের পালাবদলে ক্যাবেজ টাউন এখন অনেক গায়ক, বক্সার, কমেডিয়ান, লেখক সহ আরো বিখ্যাত মানুষের আবাসস্থল। এই পাড়ার একটি পুরানো পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে তিনজন মিলে ভাড়া থাকেন অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। দোতলায় উঠে রুমের দরোজায় নক করে দেয়ালের আড়ালে চলে যায়। ভেতর থেকে কেউ একজন দরোজা খুলতেই আমরা দুজনই অবাক। দরোজা খুললেন নাট্যকার সেলিম আল দীন।

: বাবা তুই? এখানে? কিভাবে?

: আমাকে তো নিয়ে আসলেন ফরীদি ভাই।

: ঘরে আয়, ঘরে আয়। ফাজিলটা কই? ওর উপর আমার মেজাজটা চড়ে আছে। বলে একটা মাপা হাসি দিলেন। শুনলাম রেগে থাকার কারণ। কানাডায় যেহেতু বাংলাদেশের মতো বাসাবাড়ীতে কাজের সহযোগী মানুষজন পাওয়া যায়না তাই সবাইকে নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। এই ফ্ল্যাটের রুটিন অনুযায়ী আজ সকালে নাস্তার পরোটা সেঁকা শুরু করে ফরীদি। পরোটা পুড়ে ধোঁয়া ছড়াতে থাকে তাতে বাসার ফায়ার ডিটেক্টর অন হয়ে ফায়ার এলার্ম বাজতে থাকে। সে জানেনা কিভাবে তা অফ করতে হয়। এক পযার্য়ে এলার্ম সাড়া বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে পরে। বিল্ডিংয়ের সবাই আতংকিত হয়। সবাই ফ্ল্যাট ছেড়ে নিচে নামতে শুরু করে দেয়। আর এসব যখন সবকিছুই নাগালের বাইরে চলে যায় ফরীদি বাসা থেকে বের হয়ে লাপাত্তা। ফায়ার ব্রিগেড আসে। এ্যম্বুলেন্স আসে। পুলিশ আসে। শুরু হয় এক হুলুস্থুল কান্ড। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। এসব বারবার হতে দেয়া যাবেনা তাই ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন পাঁচশ ডলার ফাইন করে গেছে। ঘটে যাওয়া বিষয়-আষয় নিয়ে বেশ রেগে ছিলেন সেলিম আল দীন। আমাকে দেখে রাগ কিছুটা কমে।

 

বসার ঘরে বসে আলাপ করছিলাম আমরা দুজন। বাসায় ফরিদা পারভীনের গাওয়া লালনের গান বাজছে।বাসায় একা একা সেলিম আল দীন শুনছিলেন।

সেতু এবং সন্তানেরা কেমন আছে? এক এক করে সবার কথা জিজ্ঞেষ করলেন।

নাক মুখ চোখ কুচঁকিয়ে ফরিদী এমন একটা ভাব করে কোমর প্যাচাতে প্যাচাতে পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দ্রুত ঘরে ঢুকে, যেন তার ইমারজেন্সি বাথরুম পেয়েছে। সেলিম আল দীনকে পার করেই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

সব প্রশ্নের দিয়ে

: আপনি এত বড় দাড়ী রাখলেন! কবে থেকে পান খাওয়া ধরলেন?

 

দাড়ীতে হাত বুলিয়ে শুধু হাসলেন, কিছুই বললেননা। হাসিটা বেশ পরিচিত। ইনিয়ে-বিনিয়ে জানতে চাইলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আর শিমুল ইউসুফ কেমন আছে? সুবর্ণা মুস্তাফা এমপি হয়েছে। রাইসুল ইসলাম আসাদ কই? পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়? আফজাল হোসেনের আঁকাআকি হচ্ছে কেমন? জহির উদ্দিন পিয়ার? অনেকের কথা জিজ্ঞেস করলেন এক এক করে। যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো যা জানি বললাম। অনেকের সঙ্গে পরিচয় নেই তাঁদের কথা বলতে পারিনি। তাঁর নিজ হাতে গড়া নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের খুটিনাটি বিষয়ে জানতে চাইলেন। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ফরীদি শাওয়ার নিতে যাচ্ছেন বাথরুমে, শুধুমাত্র একটা আন্ডারওয়ার পড়ে। কার্টুনের মত অঙ্গভঙ্গি করে জানালেন বেশীক্ষণ লাগবেনা।

: ফরীদি ফাজলামো হচ্ছে

বলে অম্ল-মধুর ধমক দিলেন সেলিম আল দীন। ধমক খেয়ে চোখের পলকে বদলে গেলেন ফরিদী। ধারাবাহিক টেলিভিশন নাটক সংশপ্তকে তার অভিনীত কানকাটা রমজানের মত ডায়লগ শুরু করেন

: বেশী বকা দিলে কিন্তু জম্পা ড্যান্স শুরু কইরা দিমু। দিমু?

বলে চলে যায় শাওয়ার নিতে। শাওয়ার নিতে নিতে বাথরুমে গলা ফাটিয়ে সেই বেসুরো গান ধরে

উয়ি আম্মা, উয়ি আম্মা।
উয়ি আব্বা, উয়ি আব্বা।।

অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম এইসব এই বাসার নিয়মিত কান্ডকারখানা।

 

মুখে পান ঢুকিয়ে বেশ রাগতস্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, প্রশ্ন শুনে মনে হলো আমাকে ধরার জন্যে বেশ মুখিয়ে ছিলেন। এবার হাতের নাগালে পেলেন

: আচ্ছা বলতো? আমি কি কখনও তোকে কোন শংসাবচন লিখে দিয়েছিলাম? কেন তোকে দেব? কি যোগ্যতা আছে তোর? তাহলে তুই ফেসবুকে কিভাবে আমার লেখা দিলি।

: আপনার দিতে হবে কেন? এই গ্রাফিক্সের যুগে আমি আপনার নামে বানিয়ে নিয়েছি।

: মানে কি?

: আপনার সিগনেচার নিয়েছি এক জায়গা থেকে আর লেখা নিয়েছি বিভিন্ন জায়গা থেকে তারপর ডিজাইন করে ফেসবুকে দিয়েছি। আমি রবীন্দ্রনাথের যুগে থাকলে তাই করতাম।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে

: বলিস কি? এতো পুকুরচুরি না, সমুদ্রচুরিও না সরাসরি গ্রহচুরি। তুই শিল্পের অভিশাপে ভস্মিভূত হয়ে যাবি, মনে রাখিস। অপরাধ যা করেছিস তুই কোনদিন ক্ষমা পাবিনা। তোর সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাধছে।

: তাহলে আমি চলে যাই স্যার? যাবো?

: তা যাবি কেন? আগে হলে বলতাম তুই আমার চোখের সামনে আর আসবিনা। এই বিদেশ বিঁভুইয়ে কিছুই বলতে পারছিনা।

আমি চুপ করে থাকি। কোন কথা বলিনা।

: এখন তুই রান্নাঘরে যা। ওখানে থালা বাসন-হাড়ি পাতিল রাখা আছে সেগুলি ধুয়ে ফেল। আমি একটু লিখতে বসবো।

 

বারান্দায় গেলেন পানের ফিক ফেলতে আর সিগারেট টানতে। ছন্নছাড়া জীবনের সংসার। এ বাসায় যে তিনজন থাকেন, সবাই তাদের নিজস্ব ভূবনে বাস করেন। কিচেনে কোন কিছুই ঠিক নেই। ধোয়া মাজা হয়না অনেকদিন ধরে। এক এক করে সব ধুয়ে যাই । বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। আমি দরোজা খুলতে যেতে যেতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এগিয়ে আসেন সেলিম আল দীন। অনলাইনে অডার্র ডেলিভারী বক্স নিয়ে যে এসেছে, সে যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপ্সরা। শরৎএর আকাশ থেকে নীল নিয়ে কপালে টিপ আর কাশবন থেকে শ্বেতশুভ্র শাদা নিয়ে শাড়ী পড়েছে । দুচোখ ভরা আলোছায়ার খেলা। বক্স দিয়ে সে চলে যায়। জানি এই অপ্সরার পৃথিবী আমি কোনদিন ছুঁতে পারবোনা কিন্তু বন্ধন রেখে গেল। টের পেলাম এরই নাম দহন।

 

বক্স খুলতেই বেরিয়ে এল একটি মাটি কাটার কোঁদাল ও কাঠের হাতল। টরন্টো সিটি কর্তৃপক্ষ শহরে বসবাসরত নাগরিকদের কাছে গ্রীস্মকালীন সব্জী চাষের জন্য ছোট ছোট প্লট লিজ দেয়। নাগরিকরা ইচ্ছেমত তা চাষাবাদ করেন। তাতে যা সবজীর ফলন হয় পরম তৃপ্তিতে নিজেরা খেয়ে, নিজের চাষকে উপভোগ করেন। সেই জন্যে চাষাবাদের জন্যে কৃষিকাজের উপকরন প্রয়োজন হয়। সেই রকম একটি প্লট লিজ নিয়েছেন এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা।
আগামী পরশু ভোর রাতে চলে আসতে বললেন। সুযোর্দয়ের সাথে সাথে জমিতে মাটি কোপাতে শুরু করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষকরা যেমন ভোর বেলায় মাঠে নামে।
আমাকে জিজ্ঞেশ করলেন,

: বাবা, পারবি না?

আমার কাজের ভার কমানোর জন্যে জানালাম তার সরাসরি ছাত্র আরিফ ও ফ্লোরা থাকে টরন্টোয়। মনে তার অনেক কথা জমে আছে। প্রতিদিন বিকালে ক্যম্পাসে যেমন ছাত্রছাত্রী নিয়ে হাটতেন আর রাজ্যের কথা বলতেন। সামনের ফ্ল্যাটে একটি স্প্যানিশভাষী পরিবার থাকে। কলম্বিয়া থেকে এসেছে, খুবই ভালো, মিশুক। তাদের সঙ্গে বেশ সদ্ভাব রয়েছে। ল্যাতিন সাহিত্য নিয়ে প্রচুর কথা হয়। গাব্রিয়েল গারসিয়া মাকোর্য়েজ তাদের প্রিয় লেখক। ওরা ভালো কিছু রান্না করলেই দিয়ে যায়। পাশের ফ্লাটে থাকে একটি স্কটিশ ফ্যামিলি তারাও ভালো তবে অতোটা মিলমিশ নেই। ওদের একটা কুকুর আছে ক্ষণে ক্ষণে তা ঘেউ ঘেউ করে। এতে তার লেখার মনেযোগ ন্ষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কুকুরটা ধরে নিয়ে দূরে কোথাও নিয়ে ছেড়ে আসতে কিন্তু এটাতো এদেশে সম্ভব নয়্। নাটক লিখছেন। মহাকাব্য। তার ধারণা ফরিদী এবার অভিনয় করে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেবেন। আমি যেন প্রতিদিন নিয়মিত এসে তার এই নাটকের পান্ডুলিপির কপি করে দিয়ে যাই কারণ তার হাতের লেখা কেউ পড়তে পারেনা। জানতে চাইলাম এখানকার মঞ্চ নাটক দেখতে যায় কি-না? বললেন, দেখেননি যে এরকম নয়, দু একটা দেখেছেন। তার সেই একই কথা, চিরায়ত বাংলা নাট্য আঙ্গিকের কাছে ইউরোপীয় নাট্যরীতি খুবই দূবর্ল, বলা যায় পরজীবী। ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারতো বটেই। আদিবাসী বাদে উত্তর আমেরিকার একই অবস্থা। ফলে এখানকার মঞ্চনাটক নিয়ে তাঁর কোন উচ্ছ্বাস নেই। যে বাসায় বসে কথা হচ্ছে সেটিও ঔপনিবেশিক বাস্তুশাস্ত্রের ফসল। ফরীদি রেডী হয়ে এসে ঢোলা একটা শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে তাড়া দিলেন দ্রুত বের হতে। ফিটফাট হয়ে আমরা যাচ্ছি কোথায় জানতে চাইলেন সেলিম আল দীন।
এ প্রশ্নের উত্তর পাশ কাটানোর জন্যে ফরীদি বড়দের বেলুন বলে একটা জোকস শুরু করতে না করতেই আবারো দরোজায় নক। দরোজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন নির্দেশক আব্দুল্লাহ আল মামুন। এই ফ্লাটের তিনজন বাসিন্দার একজন। ফরীদি চিৎকার করে বললেন

: আরে মামুন কেমন আছিস?

আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। ফরীদির দুষ্টুমিটা ধরে ফেলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন্। মিটিমিটি হেসে, মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তর দেন

: জি ফরীদি ভাই আমি ভালো আছি। আপনি ভালো?

সবাই মিলে গলা ছেড়ে হাসতে থাকি। আমাকে দেখে উচুস্বরে বললেন

: আরে বৎস। আমি তোমাকেই খুজছি। তোমার সাথে মহিউদ্দিন আহমেদ শাহীনের যোগাযোগ আছে না?

: হ্যা। ভ্যাংকুভার থাকে। প্রতিদিনই অনলাইন আড্ডা হয়।

: ও সংসপ্তক নাটকের কিছু স্টিল ফটোগ্রাফী করেছিলো। ওর কাছে সব আছে। সেগুলো আমার একটু প্রয়োজন্। আজকে তোমরা বের হয়ে যাচ্ছ, যাও। তুমি সময় করে একদিন আসো অনেক আলাপ আছে। কাজ আছে।

 

আব্দুল্লাহ আল মামুন নতুন ফিল্ম করছেন। সেইসব নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।

আমরা বের হয়ে যাই। আজ বারে যাচ্ছি সেজন্যে গাড়ী নেয়া যাবে না। পান করে এই শহরে গাড়ী চালানো যায়না। ভীষন কড়াকড়ি, নিষেধ। যেতে যেতে ফরীদিকে জানালাম, টুকু বাংলাদেশে, মনিশ ফোন ধরেনি মনে হয় কাজে, বনি আসতে পারবেনা, আর আমাদের জন্যে ময়না অপেক্ষা করছে ডাউন টাউনে। আমরা ট্রেনে উঠি। খুব একটা লোকজন নেই। ট্রেনে দুমিনিট পর পর স্টপেজ। হঠাৎ ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ভীষণ বাজে গন্ধ । পরের স্টপেজে একজন হন্তদন্ত হয়ে নেমে গেল। বুঝা গেল লোকটা কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত তাই নিজেকে আড়াল করে নিল। এক শ্বেতাঙ্গ যুগল। বুড়োবুড়ি। একজন আরেক জনকে খুব বিনম্র এবং নিচু স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেশ করে

: ইউ ডিড ইট?

: নো।

: ইউ?

: নেভার।

 

আমরা সেই যুগলের আড়াআড়ি বসা। দুজনেই ঘাড় কাত করে আমাদের দিকে তাকায়। ফরীদি বলে উঠেন

: দেখলা। সন্দেহের রাডারটা কিন্তু আমাদের দিকে তাক হইছে।। পৃথিবীটা এরকমই, ঘটায় একজন আর দোষ পড়ে অন্যজনের।

এ নিয়ে দুজন হাসাহাসি করতে করতে পৌছে যাই। ডাউনটাউনের একটা সাবওয়ে স্টেশনে নেমে কিছুটা পায়ে হেঁটে আমরা একটা কিউবান বারে আসি। বেশ জমজমাট। যদিও খুব লো ভলিয়্যুমে কিউবান মিউজিক বাজছে কিন্তু শরীরের ভেতর কেমন যেন একটা দুলুনী এনে দেয়। মৃদু আলোয় দুলতে দুলতে আমরা বারের মাঝামাঝি টেবিলটা বেছে নিই। এই বারে শুধু কিউবানরা আসে এরকম নয়। সাদা-কালো-বাদামী সব ধরণের মানুষেরাই আসে। বিশেষ করে ইন্টেলেকচুয়ালরা। একটু কানপাতলেই শোনা যায় সমকালীন শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। আলাপ আলোচনা।

 

ম্যানু হাতে নিয়ে ফরীদি বললেন আজকে একটা মজার ককটেল হেমিংওয়ে ডাইকুইরি পান করার জন্যে। নোবেল জয়ী লেখক আনের্স্ট হেমিংওয়ে যখন কিউবা থাকতেন তখন এই ককটেল পান করতেন। এটি রাম থেকে তৈরী হয়। হাভানায় বেশ জনপ্রিয়। সাথে অর্ডার দিলেন কিউবান খাবার বনিয়াতো কোন মোজো। হেমিংওয়ে ডাইকুইরিতে চুমুক দিতে দিতে সরব হয়ে উঠে ময়না।
: ফরীদি ভাই, আপনার মনে আছে? আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে, আপনারা বের হয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের র‌্যাগ ডে, বাংলা খেয়ে সবাই টাল। জুনিয়ররা ধরলো আপনাদের, শুধু কি আপনারা একাই র‌্যাগ ডে উদযাপন করবেন? আপনি কি করলেন? একটা চকচকে নতুন টিনের বালতিতে অনেকগুলি বাংলা মদের প্যাকেট ঢেলে বালতি ভরে জাহাঙ্গিরনগরের সেন্ট্রাল ক্যাফের ছাদে উঠে ক্যাফের মেইন পানির ট্যাংকিতে ছেড়ে দিলেন। আর যায় কই? সবার প্রশ্ন কি হচ্ছে? কি হচ্ছে? তারপর সবাই লাইন ধরে বেসিন থেকে গ্লাসের পর গ্লাস টেপের পানি খায় চুক চুক করে। আর কি যে থ্যাংকস জানালো আপনাকে।

এইসব শুনে ফরীদি গলা ছেড়ে হো হো করে হাসলেন। আর মাঝে মাঝে সিগারেট ফুকতে বাইরে যাওয়া চলছে।

তারপর আমি ধরলাম আরেক গল্প। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ারে। ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে প্রাক্তনদের রিইউনিয়ন। হুমায়ুন ফরীদি তখন বাংলা ফিল্মের হিরো। প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে ফরীদি গেলেন অনুষ্ঠানে। সবাই উৎসুক তাকে দেখবে, তার কথা শুনবে। এবার ফরিদীর কথা বলার পালা। মঞ্চে মাইকের সামনে গিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে সবার দিকে তাক করে ফিল্মি কায়দায় হুমকী দিতে থাকেন। কোন নড়াচড়া করা যাবে না। নড়লেই গুলি করুম। অডিয়েন্স সবাই ভয় পেয়ে যায়। আয়োজকরাও বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে? সূযোগ বুঝে সামনে থেকে দু চার জন দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করে। কি যে এক আতংকিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়! এক কথায় রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ। হঠাৎ নাটকীয়ভাবে শার্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরায় পিস্তল দিয়ে। তখন সবাই বুঝতে পারে এটি একটা লাইটার। সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। পুরো অডিয়েন্স জুড়ে শুরু হয় হাসি। একজন আরেক জনের উপর হাসতে হাসতে ঢলে পরে।

 

একটা ফোন কল আসে হুমায়ুন ফরীদির। মিতা, মিতা বলে একটু পর কলব্যাক করবেন জানিয়ে ফোনটা রাখতে রাখতে বললেন লেখক হুমায়ুন আহমেদ। ফরীদি শোনালেন যাত্রায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা, জাহাঙ্গীরনগর ভাসির্টিতে তার প্রথম নাটক করা, লাইব্রেরীর বই ফেরত না দেয়া, মাস্টাসের সাটির্ফিকেট না নেয়া আরো কতো কি? আহারে বল্গাহীন ছাত্র জীবন!ক্যাম্পাসের জীবন!কি যে রঙ্গিন!কি যে বর্ণময়!হাসতে হাসতে ময়না বললেন

: ফরীদি ভাই, আপনার হেমিংওয়ে তো ফাটাফাটি জিনিস।

: নাও। নাও মিয়া। আরো নাও

আনের্স্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি’র মূল চরিত্র বুড়ো সান্তিযাগোর সংগ্রাম মানেইতো মানুষের সংগ্রাম। মায়াকোভস্কির কবিতা, এডগার এ্যালেন পোর বিড়াল থেকে হারুকি মুরাকামীর বিড়াল। টরন্টো শহরের স্ট্রিট কার দেখলেই তার মনে পড়ে কোলকাতার ট্রামবাসের কথা আর ট্রামবাসের প্রসঙ্গ আসলেই চলে আসে কবি জীবনাননাদ দাশ । বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে দেন পর্তুগীজ লেখক হোসে সারমায়াগোর দ্যা ব্লাইন্ডনেস উপন্যাসকে। একটি শহর অদ্ভূত অন্ধত্বের মহামারীতে আক্রান্ত হয়। শহরের মানুষেরা একের পর এক অন্ধত্ব বরণ করতে থাকে। মহামারীতে কিভাবে হারিয়ে যায় মানুষের মূল্যবোধ, আপন মানুষ হয়ে যেতে তাকে চূড়ান্ত স্বাথর্পর। পুরো গল্পের সাথে লালনের গান এতো দেখি কানার হাটবাজারের অদভূত রকমের মিল দেখানোর চেষ্টা করলেন। তন্ময় আর মুগ্ধতার সাথে আড্ডা চলতেই থাকে। রাত তিনটা বাজে, বারের লোকজন জানায় সময় শেষ এবার বার ছেড়ে চলে যেতে, বন্ধ করার সময় হয়েছে। চারপাশ তাকিয়ে দেখি বার একবারেই খালি কেউ নেই। আমরা বের হয়ে রাস্তায় নামি। বাউরী বাতাস বাইরে । ল্যাম্পপোস্ট গুলিকে বড়োবেশী নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। সুনসান নিরব রাস্তা। মানুষজন একেবারেই নেই, মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ী সা সা শব্দ করে চলে যাচ্ছে। তিনজনেই কিছুক্ষণ রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসে থাকি চুপচাপ। নিরবতা ভাঙ্গলেন ফরীদি

: এত রাতে বাসায় গিয়ে কি হবে? তারচে বরং চলো বীচে যাই।

 

বীচ এখান থেকে হাটা পথ। হাটতে হাটতে কেমন যেন স্মৃতিপ্রবণ হয়ে উঠেন । এক এক করে জিজ্ঞেস করেন আশরাফুল আলম রিপন কেমন আছে? প্রীতম কোথায় থাকে? লন্ডন না ঢাকায়? মাসুদ হাসান উজ্জ্বল? সাজু খাদেম নাকি তার একটা পোট্রেট করেছে?কামাল বায়েজীদ? এসব প্রশ্ন শুনে আর উত্তর দিতে দিতে লেকের পাড়ে চলে আসি। লেক তো নয় যেন সমুদ্র, বিশাল বিশাল ঢেউ সাথে সমুদ্রের মতো গর্জন। বীচের শো শো শব্দ কেমন যেন গোঙ্গানীর মত শোনায়। বিরামহীন, অনিমেষ ঢেউ আছড়ে পরছে তীরে । অন্ধকারে লেকের জল অনেক জ্বলজ্বল করে উঠে। বীচেও কেমন যেন রহস্যময় আলো আলো ভাব। এরকম একটা পরিবেশে বিশাল জলরাশি মানুষকে উদাসীন করে তোলে। বীচের অস্ফুট আলোয় দেখা যায় ফরীদির চোখ দুটি চিকচিক করছে। ধরে আসা গলায় প্রশ্ন করলেন

: আচ্ছা দেবযানীর কোন খবর জানো?

প্রশ্নটা শুনে থমকে যাই

: আমার মা, মেয়েটা আমার। ওরা…

কথা শেষ না হতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু। আমরা অপ্রস্তুত হয়ে যাই তারপরও শান্ত্বনা দিতে থাকি, কিছুতেই কিছু নয়। কান্না বাড়তে থাকে। কান্না মিশে যায় ঢেউয়ের শব্দে। মানুষের কান্নার সাথে ঢেউয়ের আর্তনাদের অসম্ভব মিল আছে। আহারে মায়া! মূতির্র মত দাড়িয়ে থাকি দুজন। মোমের মত গলতে গলতে যেন ক্ষয় হতে থাকে শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি।

 

 

লেখক: পারভেজ চৌধুরী, কবি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব