গল্প : নিকোলা এবং বিষাদের দিনগুলি

By: পারভেজ চৌধুরী ২০২০-০৫-১৫ ৪:০৭:৫৪ পিএম আপডেট: ২০২৪-১২-২১ ১০:৫৯:১১ এএম সাহিত্য

জুস ক্যান হাতে নিয়ে মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো
: এটা তো জুস নেয়ারই কথা! নাকি তেল?
: না। না। জুস ঠিকই আছে। আমিও হাসতে হাসতে বলি, আর ভুল হবেনা।
ব্যালে ড্যান্সের মত ছন্দময় গতিতে সব জিনিস ব্যাগে ভরে দেয়। কার্ড দিয়ে টাকা দিই।
: আবার দেখা হবে। ভালো থেকো।
: তুমিও।

মেয়েটা আবার হাসি শুরু করে। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা।
ব্যাগ হাতে নিয়ে শপিংমল থেকে বের হয়ে যাই। হাসতে হাসতে বিদায় জানায়। পা রাখি এয়ারপোর্টের মত বিশাল পার্কিং লটে। মেয়েটার হাসি কানে বাজতে থাকে, বাজতেই থাকে। বয়স কত হবে? উনিশ-বিশ। বেশ হাসি খুশি, মিশুক।

একটা ঘটনা ঘটেছিলো এরপর থেকে মেয়েটা আমাকে দেখলেই হাসে। করোনাকালের প্রথম দিকে। লকডাউন নিয়ে কানাডার মিডিয়াতে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে প্রতিটি শহর লকডাউন হয়ে যাচ্ছিলো একের পর এক। চারপাশে চাপা উত্তেজনা, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। একটা গুমোট পরিস্থিতি। মানুষ দলে দলে কেনাকাটা করছে। পাগলের মত শুকনো খাবার, টিস্যু, স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লোভস আর ম্যাস্ক কিনছে। সবার চোখে মুখে আতংক। শপিংমলের র‌্যাকের পর র‌্যাক খালি হয়ে যাচ্ছে এক নিমিষেই।

পর পর চার পাঁচ দিন গিয়েও আমি স্যানিটাইজার, ম্যাস্ক আর হ্যান্ড গ্লোভস পাইনি কোথাও। এ সময়ে ম্যাস্ক আর হ্যান্ড গ্লোভস ছাড়া বাইরে বের হতে ভয় লাগে। এমনই একটা সময় যাচ্ছে নিজের হাত, হাতের আঙ্গুলকে শত্রু মনে হয়।

বেশ কয়েকদিন ঢুঁ মারার পর হঠাৎ গিয়ে দেখি শপিংমলের র‍্যাক ভরা ম্যাস্কের অনেক প্যাকেট। প্যাকেটে নীলাভ ম্যাস্কের ছবি। মনে হলো এখনই সবাই হুমড়ি খেয়ে র‌্যাকের তাক গুলি খালি করে ফেলবে পঙ্গপালের মত। এরই মধ্যে যে সব সামগ্রীর চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে সেইসব কেনার মধ্যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই ম্যাস্কের র‌্যাকে এরকম কোন নিয়ম লেখা না দেখে এক কর্মীকে ডেকে জিজ্ঞেস করি এই প্যাকেট আমি কয়টা এক সঙ্গে নিতে পারি?
: তোমার যা ইচ্ছে।
ভ্রু কুঁচকিয়ে নির্লিপ্ত উত্তর দিয়ে অন্য কাজে চলে যায়।

চোখের পলকেই শেষ হয়ে যাবে এই ভয়ে আশেপাশে তাকিয়ে আমি মাঝারী তিন প্যাকেট নিয়ে মেঝেতে আঁকা শারীরিক দূরত্বের মানচিত্র বেয়ে কাউন্টারের দিকে যাই। প্লুত হাসির পরাগ ছড়িয়ে মেয়েটা কার্ডের মাধ্যমে দাম রেখে আমাকে ভাউচার ধরিয়ে আবার হাসি দেয়। ভারী সুন্দর সে হাসি যেন মুক্তা ছড়ায়। কাউন্টার ছাড়তে ছাড়তে ভাউচারে দেখি আকাশ থেকে নেমে আসা এই পরীটার নাম নিকোলা কিন্তু প্রোডাক্টের নাম দেখে আমি আৎকে উঠি।
: তুমি তো ভুল করেছো, গাইজ।
: কেন? কি হলো ?
: আমি তো ম্যাস্ক নিয়েছি কিন্তু তুমি তো দেখাচ্ছো এটা স্যানিটারী ন্যাপকিন।
: ব্যাগ থেকে প্যাকেটগুলো বের করো তো দেখি? মুখ গম্ভীর করে পেশাদারীত্বের চ্যালেন্জ নিয়ে বলে আমাকে

প্যাকেটগুলি আমি নিকোলার ডেস্কে রাখি। দেখে বলে ঠিকই তো আছে। ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি ভুলটা আমারই হয়েছে। জীভ কাটি লজ্জায়। আতংক মানুষকে এভাবেই তাড়ায়, দিশেহারা করে ফেলে। নিচু গলায় বলি …
: সরি । প্যাকেটে ছবি দেখে ভেবেছিলাম এগুলি ম্যাস্ক। কিন্তু এখন দেখছি ন্যাপী। এইসব তো আমার প্রয়োজন নেই। সব ফেরত দিতে চাই।

আমার কথা শুনে নিকোলা হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে যেন মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। অতি সাবধানে টিস্যু দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো
: তোমাকে ধন্যবাদ। কোভিডের এই বিষাদময় দিনে মনটাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে, হাল্কা করে দেয়ার জন্যে। আমি অনেক মজা পেলাম। মনে হচ্ছে তুমি বেশ মজার মানুষ।

বলে আবার হাসি শুরু করে। আমি থ’ হয়ে দাড়িয়ে থাকি। আবারো নিজেকে সামলিয়ে আরেকটি কাউন্টার দেখিয়ে বললো
: ঐখানে যাও। আমার ফেরত নেবার নিয়ম নেই। ও নেবে।
জোড়ে মহিলাকে বলে দেয়
: স্টেলা। ওর এ গুলি ফেরত নাও। আর গল্পটা শুনে নিও।

আমি স্টেলার কাছে যাই। বর্তমান এই আতংকিত সময়ে কাস্টমার কম ফলে সবার কাজের চাপ একটু হাল্কা। স্টেলা আমাকে জিজ্ঞেস করে ঘটনা কি? ও হাসছে কেন এত?
ঘটনাটা বলি। শুনে স্টেলা হাসতে হাসতে আমার টাকা রিফান্ড করে দিলে আমি শপিংমল থেকে বের হয়ে যাই।

টরন্টোয় আমরা যে পাড়ায় থাকি সেটি চাইনিজ অধ্যুষিত। বেশ জমজাট। স্বাভাবিক সময়ে মনে হতো আমি চীনের কোন অংশে আাছি। দোকান, রেস্টুরেন্ট কিংবা শপিং মলে চাইনিজ গান, রাস্তায় চাইনিজ মানুষ। এখন আর এইসব বোঝা যায়না। সবাই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। পাড়াটাকে বড়োবেশী নিথর, নিস্তেজ মনে হয়। এ্যাপার্টম্যান্ট কম্পাউন্ডে ঢুকতেই দেখি ফুলের ঝাকড়া গাছের আড়ালে বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে ফার্নান্দো সিগারেট টানছে। ওকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি কিন্তু ওর ইংরেজী শুনে মনে হয় ফার্নান্দোর ব্যাকহোম ক্যারেবিয়ন অঞ্চলে। আমি হ্যালো বলতেই
: কোথায় গিয়েছিলে?
: ম্যাস্ক খুঁজতে কিন্তু কোথাও পাইনি।
: শোন এসব সাধারণ দোকানে পাবেনা। হাসপাতালের ফার্মাসীতে যাও সেখান থেকে সংগ্রহ করো।
: তোমাকে ধন্যবাদ
: আরও শোন, খুব বেশী বাসা থেকে বের হয়োনা। টরন্টোর অবস্থা খুব ভালো নয়। দিন দিন কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

ফার্নান্দোকে আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরে ফিরি। ওর কথা যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেই বাইরে আর বের হবো না, পুরাপুরি ঘরে থাকার।

ঘরবন্দী মানে জনস্বাস্থ্যের পরিভাষায় কোয়ারিন্টিনে আছি অনেক দিন ধরে।

ইউরোপে প্লেগের মহামারী দেখা দিয়েছিলো ১৪শ শতকে। প্রায় ১৯/২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। প্লেগের সংক্রমন ঠেকাতে ভেনিস নগরের কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করে বন্দরে কোন জাহাজ ভীরলে যাত্রীদের ৪০ দিন সমুদ্রে নোঙ্গর করে রাখতে হবে। চল্লিশ শব্দের ইটালিয়ান ভাষা কোয়ারান্তা। সেই সময়টিকে বলা হতো কোয়ারিন্তিনো। সেই থেকে কোয়ারিন্টিন শব্দটি।

কাঁচঘেরা জানালা দিয়ে আকাশ আর দিনরাতের সুনসান নিরবতা দেখি। ফোনে ফোনে স্বজন-সুজনদের সাথে যোগাযোগ। টেলিভিশনের নিউজ থেকে পৃথিবীর খবর পাই। ঘরে থাকতে থাকতে দিন বার তারিখ সব গুলিয়ে ফেলি। দিন রাত্রির পালা বদলে করোনা সংক্রমনের হার কমতে থাকে। প্রতিদিনের খবরে একটু একটু করে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার আঁচ পেতে থাকি। মানুষের ঘরের বাইরে বের হওয়ার নিয়ম শহরে পর্য়ায়ক্রমে শিথিল হতে থাকে। একদিন বাজারের জন্যে বের হই। রাস্তায় মানুষের চোখে মুখে স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস। সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছে। হাসছে। এক অপরকে হাই বলছে, হ্যালো বলছে। হাত নাড়াচ্ছে। মানুষ মুক্তি পেলে, মুক্ত হলে ভীষণ ছন্দময় হয়ে উঠে। সবাই যেন ব্যালে ড্যান্স করছে। আকাশ ঝকঝকে নীল। 

তিরিতিরি বাতাস। নরোম রোদের বিকেল। শপিংমলে আগের মতো আর নিরবতা নেই। লোকজনের ভীর বাড়ছে। বাজার শেষ করে আমি কাউন্টারের দিকে তাকাই। কোথাও নিকোলাকে দেখতে পাইনি। বোধ হয় এই বেলা কাজের শিডিউল নেই। স্টেলা আছে। ওর কাউন্টারে লম্বা লাইন তবুও সেখানে দাড়াই। যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে। আমি সিরিয়ালে চলে আসি। 

প্রথমেই আমাকে চিনতে পারেনি। স্টেলাকে হ্যালো বলে জানতে চাই কেমন আছে? মন ভারী করে জানায় ভালো নেই। কাজ করতে করতে আমাকে প্রশ্ন করে
: তুমি নিকোলাকে চিনতে না?
: হ্যা।
: গত পরশু রাতে কোভিড নাইনটিনে নিকোলা মারা গেছে।
শুনে এক ধরণের ছোটখাট চিৎকার দেই
: বলো কি?
: ঠিকই বলছি।

কোভিড সংক্রমনের ভয়ে মেয়েটা কাজ থেকেও ছুটি নিয়েছিলো কিন্তু পরিবার থেকেই সংক্রমিত হয়েছে। আমার পা আটকে যায় ফ্লোরে। দাড়িয়ে থাকি। পেছনে লোকজনের ভীর জমে যাচ্ছে। জিনিসপত্র নিয়ে শপিংমল থেকে বের হই। বলে কি? নিকোলার মুখ আর আমার মেয়ের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সমতল পার্কিং লট কেমন যেন পাহাড়িয়া রাস্তার মত উঁচুনিচু লাগছে। হাটতে পারছিনা পা দুটি আটকে যাচ্ছে বারবার। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কোনকিছুই দেখতে পারছিনা ভালো করে…

 

পারভেজ চৌধুরী, কবি ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।