আমেরিকায় দাস প্রথা (প্রথম পর্ব)

২০২০-০৬-০৮ ৯:৪১:৫০ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-১৯ ২:৪১:০২ এএম ইতিহাস
শিল্পীর তুলিতে আঁকা বন্দী আফ্রিকানদের বহনকারী জাহাজ

আমেরিকার ইতিহাস থেকে জানা যায়, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে দাসপ্রথা মহামারী আকার ধারণ করে সেখানে। আফ্রিকান দাসরাই তাদের শ্রম দিয়ে তখন দেশটিকে পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত করে। তামাক ও তুলার মত লাভজনক শস্যের চাষ করানো হত সেসব দাসদের দিয়ে। এর সূচনা হয় ১৬১৯ সালে। জানা যায়, ডাচরা সর্বপ্রথম আফ্রিকানদের খাঁচায় বন্দী করে আমেরিকায় নিয়ে আসে। সেই থেকে আমেরিকানদের পরিচয় ঘটে মানুষ বেচাকেনার বাজার হিসেবে।

এর বিলোপ ঘটে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় আমেরিকার পশ্চিমাভিমুখ সম্প্রসারণ এবং ‘অ্যাবলিশন মুভমেন্ট’ দাসপ্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধের ওই সময়টায় দাসপ্রথার পক্ষে ও বিপক্ষে নানা মত পুরো আমেরিকান জাতিকেই মতাদর্শের দিক থেকে বিভক্ত করে দেয়। শেষতক গৃহযুদ্ধে দাস ব্যবস্থা রদের পক্ষে থাকা ইউনিয়নের জয় হয়। 

ইউনিয়নের বিজয়ের ফলে প্রায় ৪০ লক্ষ দাস দাসী  মুক্তি পায়। কিন্তু দাসপ্রথার এ সংস্কৃতি পরবর্তী আমেরিকান ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আমেরিকার পুনর্গঠনের যুগ থেকে সিভিল রাইট মুভমেন্ট পর্যন্ত- যেটি সঙ্ঘটিত হয়েছিলো দাসপ্রথা বিলোপের প্রায় এক শতাব্দী পর। সবকিছুর ওপরই সেই নিন্দিত সংস্কৃতির গভীর ছাপ প্রত্যক্ষ করা যায়।  দীর্ঘ এ ইতিহাসের শুরুটা কেমন ছিল? চলুন জেনে নিই এই প্রতিবেদনে।

 

দাসপ্রথা সূচনা

একটি ডাচ জাহাজে করে ২০ জন আফ্রিকানকে খাঁচায় বন্দী করে আনা হয় ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে, ১৬১৯ সালে। ভার্জিনিয়াসহ গোটা আমেরিকা তখন ছিলো ব্রিটিশ উপনিবেশভূক্ত। তখন উত্তর আমেরিকায় খুঁটি গেড়ে বসেছে ইউরোপীয় সওদাগররা। তারাই ছিলো তখনকার আমেরিকান সমাজের জোতদার, জমিদার, মহাজন। তারা দেখতে পেলো, স্বাধীন শ্বেতাঙ্গ মাসিক বেতনভোগী চাকরদের বদলে এইসব আফ্রিকানদের কিনে নিয়ে দাস হিসেবে ব্যবহার করা গেলে অনেক পয়সা বেঁচে যায়।  

আসল পরিসংখ্যান পাওয়া যদিও কঠিন, তবু ঐতিহাসিকদের মতে অষ্টাদশ শতকে আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গকে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় আমদানি করা হয়েছিলো। এরা ছিল আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন নরনারী। 

অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার দক্ষিণের তামাক উৎপাদনের জমিগুলো অনাবাদী হয়ে পড়ায় সেখানে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় ও ক্রমবর্ধমান দাস ব্যবসায় ভাটা পড়ে। একই সময়ে ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল কারখানাগুলোর বেশ বিস্তৃতি ঘটে। ফলে ব্রিটিশ মুলুকে আমেরিকান তুলার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণে তুলা ভালো জন্মাতো। কিন্তু তুলা চাষের জন্য কাঁচা তুলার আঁশ থেকে বীজ ছাড়িয়ে ওই বীজ বপন করতে হতো; যা ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। 

১৭৯৩ সালে এলি হুইটনি নামক একজন তরুণ আইরিশ স্কুল টিচার কটন জীন নামে একটি মেশিন আবিষ্কার করেন। যেটি দিয়ে সহজেই কাঁচা তুলার আঁশ দিয়ে বীজ আলাদা করা যেতো। এটির ব্যবহার খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে তুলা চাষের জন্য দাসদের উপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে যায়। 

১৮০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফ্রিকা থেকে দাস আমদানি বেআইনি ঘোষণা করে। আমদানি বন্ধ হলেও অভ্যন্তরীণ দাস ব্যবসা চলতে থাকে রমরমা। পরবর্তী ৫০ বছরে দাসদের সংখ্যা বেড়ে ৩ গুণ হয়। ১৮৬০ সালে তাদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ। যা ছিলো দক্ষিণের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি! 

প্রভুরা এমনভাবে দাসদের নিয়ন্ত্রণ করত, যাতে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে প্রভুদের আয়ত্তে থাকে। দাসদের আলাদা একটা গণ্ডি ছিলো। একজন দাস আরেকজন দাসকেই শুধু বন্ধু বা সঙ্গী হিসেবে পেতে পারত। নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে তারা যেতে পারত না। দাসদের জন্য পড়ালেখা শেখা ছিলো নিষিদ্ধ। 

প্রভুরা তাদের অধীনে থাকা সব দাসীদের সাথে চাইলেই যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারতেন। একান্ত বাধ্যগত দাসদের প্রভুরা নানা রকম পুরস্কার দিতেন, আর কেউ বিদ্রোহ করতে চাইলে তার উপর নেমে আসতো কঠোর শাস্তি। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে সংখ্যায় এত বেশি হওয়ার পরও দাসরা কেন প্রভুদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করত না ! এখানেও কূটকৌশল প্রয়োগ করে রেখেছিলো শাসকগোষ্ঠী। দাসদের মধ্যে যারা বেশী দক্ষ বা পারদর্শী অথবা শিল্পী , তাদেরকে অন্যান্য দাসদের থেকে অধিক মর্যাদা দেয়া হতো। এতে করে দাসশ্রেণির মধ্যেও উঁচু নিচু জাতের বৈষম্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলো শাসকরা। স্বাভাবিকভাবেই অধিক সম্মানপ্রাপ্ত দাসরা তাদের থেকে নিচু জাতের দাসদের তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো। এ কারণে কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা সবাই এক হয়ে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে পারে নি। 

দাস বিবাহপ্রথার কোন আইনি ভিত্তি ছিলো না, দাসরা চাইলে তাদের পছন্দনীয় দাসীদের বিয়ে করতে পারত এবং বিয়ের পর সন্তান-সন্ততি নিয়ে বড় পরিবার গড়ে তুলত। এ ব্যাপারে প্রভুরা দাসদের উৎসাহ দিতেন। কারণ দাসের ছেলে মেয়ে যে দাসই হবে! তারাও কাজ করবে ওই প্রভুরই অধীনে। তারপর শক্ত সামর্থ্যবান হয়ে গেলে চড়া দামে বাজারে বেঁচে দেয়া যাবে। এভাবে অনেক দাস পরিবার ভেঙ্গে যেত, দেখা যেত এক পরিবারের সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।  এমনই নোংরা চক্রান্ত করত প্রভুগোষ্ঠী। 

 

দাস বিদ্রোহ 

সে সময় মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ছোট ছোট বিদ্রোহ সংঘটিত হতো। বিদ্রোহগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো গ্যাব্রিয়েল প্রশের নেতৃত্বে রিচমন্ড বিদ্রোহ (১৮০০) এবং ডেনমার্ক ভেসার নেতৃত্বে চার্লসটন বিদ্রোহ (১৮২২) । কিন্তু খুবই কম সংখ্যক আন্দোলনই সফলতার মুখ দেখেছিলো। প্রভুরা কঠোর হাতে এসব আন্দোলন দমন করতেন। 

তবে যে দাস আন্দোলনটি শ্বেতাঙ্গ প্রভুগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো সেটি সংঘটিত হয় ১৮৩১ সালের আগস্টে। ভার্জিনিয়ার সাউদাম্পটন কাউন্টিতে হওয়া আন্দোলনটিতে নেতৃত্ব দেন ন্যাট টারনার। ন্যাটের সঙ্গী ছিলো ৭৫ জন প্রতিবাদী দাস। তাঁরা সবাই মিলে দুই দিনে প্রায় ৬০ জন অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ মানুষকে হত্যা করে। পরে সরকারী মিলিশিয়ারা এসে অস্ত্রের মুখে আন্দোলন প্রতিহত করে। 

কিন্তু ন্যাটের বাহিনীর কার্যকলাপে সুযোগ পেয়ে যায় শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারীরা। তারা বলতে থাকে, আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরা যে আসলে কতটা বর্বর জাতি তা ভার্জিনিয়ার নৃশংসতা দিয়েই প্রমাণিত হয়, তাই তাদেরকে সভ্য মানুষে পরিণত করার জন্য দাসপ্রথা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাই দাসদের ব্যাপারে আইন আরও কঠিন করা হয় , যাতে তারা কখনোই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মুক্তির পথে পা বাড়ানোর সাহস না পায় !

 

বিলোপ আন্দোলনে

এদিকে দক্ষিণে দাসদের বিরুদ্ধে এই দমননীতির প্রয়োগে উত্তর উত্তাল হয়ে ওঠে। এক কথায় বলতে গেলে ইতোমধ্যেই জ্বলতে থাকা দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ১৮৩০ থেকে শুরু করে ১৮৬০, এ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হতে থাকে। ফ্রেড্রিক ডগলাসের মত কৃষ্ণাঙ্গ দাসও নেতা যেমন এতে নেতৃত্ব দেন, তেমনি শ্বেতাঙ্গ কিছু সমর্থকদেরও অবদান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মুক্তচিন্তার বাহক পত্রিকা দ্য লিবারেটরের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন, দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লেখা তুমুল জনপ্রিয় উপন্যাস আঙ্কল টম'স কেবিন এর লেখক হ্যারিয়েট বেকার স্টো প্রমুখ ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিত্ব, যারা দাসপ্রথা লোপের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন দিয়েছিলেন। 

১৭৮০ এর দশকে স্বাধীন কৃষ্ণাঙ্গরা এবং উত্তরের কিছু দাসপ্রথা লোপের পক্ষে থাকা ব্যক্তির উদ্যোগে দক্ষিণের কিছু দাসকে মুক্ত করা সম্ভব হয়। মাটির নিচের সুড়ঙ্গ দিয়ে বিশেষভাবে তাদের পালাতে সাহায্য করা হত। এই প্রক্রিয়াটি ১৮৩০ এর দিকে আরও গতি পায়। ৪০,০০০ থেকে ১ লক্ষ লোক পালাতে সক্ষম হয়। এই সফলতা আমেরিকার উত্তরাংশের মানুষকে দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। 

 

সূত্রঃ হিস্ট্রি ডট কম