- ● যেভাবে ‘টেসলা’য় কর্মরত বাংলাদেশের রাফা
- ● A Decade of Recitation Elegance: Bachonik Celebrates 10 Years of Artistic Brilliance
- ● বর্ণাঢ্য আয়োজনে বুয়েট নাইট অনুষ্ঠিত
- ● ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’-এ ভূষিত বঙ্গবন্ধু
- ● শনিবারের কলমে হিমাদ্রী: মায়ের “শেখসাব”
- ● সুখী দেশের তালিকায় কানাডা ১৫তে, শীর্ষে ফিনল্যান্ড
- ● গিনেস বুকে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’
- ● দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দশ তরুণ নেতাদের তালিকায় মাশরাফি
- ● ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ২০২১ পাচ্ছেন যারা
- ● প্রসংশায় ভাসছে জিয়া হাসানের সাথে ঘরোয়া’র স্বত্বাধিকারীর আলাপচারিতা
কালে কালে পরকীয়া পাঠ
বিরক্ত হয়ে ফোন ধরল রাকিব। হ্যালো। কোনো জবাব নেই। ওপাশে যে ছিল কোনো কথা না বলেই সে কল কেটে দিল। আননোন নাম্বার। কে ফোন করল বোঝা গেল না। সম্ভবত শুভ্রার অসংখ্য ভক্তকুলের কেউ। না কি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রেমিক? রাকিবের কপালে দুটো ভাঁজ। শুভ্রা কি রাধা? রাকিব আয়ান ঘোষ? তাহলে বাধা দিয়ে লাভ হবে না। যুগে যুগে শিল্প সাহিত্যকে সমৃদ্ধ আর পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙে চুরমার করাই তো পরকীয়া প্রেমের কাজ।
কবে শুরু পরকীয়ার। তা প্রেম না কি বহুগামিতা?
মানুষ যখন সবেমাত্র গোষ্ঠিজীবনে প্রবেশ করছে, নারী তখন জঙ্গম সম্পত্তি নয় কারও। বরং নারীর অধীনেই সমাজ। বহুগামিতা তখন নিন্দনীয় নয় বরং প্রয়োজনীয়–জিনগত বৈচিত্র্যের জন্য। বহু পুরুষ ও বহু নারীর জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের আদান প্রদান দরকার। দরকার উন্নত জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানব সন্তানের জন্ম হওয়া। পরকীয়া বলে তখন কিছু নেই। কারণ সব নারী এবং সব পুরুষই সকলের। অবাধ সম্পর্কের কাল তখন। এই রীতির অবশেষ চলেছিল আরও বহুদিন।
মহাভারতের মহর্ষি উদ্দালক আর তার ছেলে শ্বেতকেতুর কথা এখানে বলা চলে। শিশু শ্বেতকেতু আর স্বামী উদ্দালকের সামনে দিয়েই স্ত্রী চলে যাচ্ছে অন্য এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিহারে। শ্বেতকেতু অস্থির। উদ্দালক নির্বিকার। স্ত্রী যাচ্ছে ক্ষতি নেই, ফিরলেই হল। অস্থির শিশুপুত্রকে সান্ত¡না জানিয়ে বলছে, এটাই স্ত্রী জাতির ধর্ম। সে সময় অর্থাৎ বৈদিক যুগে ‘গো ধর্ম’ বলে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল। গোধর্ম মানে গরুর মতো যত্রতত্র বিহার। তখনও সংস্কৃত রসশাস্ত্রের স্বকীয়া, পরকীয়া পার্থক্য নির্দেশিত হয়নি। কারণ নারীপুরুষের সংগম তখনও শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
যদিও তখন স্বামী আর স্ত্রীর সম্পর্ক প্রচলিত। বিয়ে হচ্ছে। তা রাক্ষস, আসুর, গান্ধর্ব যাই হোক না কেন। পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে নারী কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমিতভাবে গণ্য হচ্ছে। কিন্তু সে তখনও একেবারে আবদ্ধ নয়। অর্থাৎ নারীর ওপর তখনও নিরঙ্কুশ আধিপত্য নেই পুরুষের। পরের স্ত্রী ও পরের স্বামীকে কামনা করা নিন্দনীয় হলেও গর্হিত নয়।
কামনা বলা হল কারণ তখনও ভালোবাসা নামক বোধটির উৎপত্তি হয়নি। বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে কামনা করছে চন্দ্র। হরণ করেও নিয়ে যাচ্ছে। সপ্তর্ষির স্ত্রীদের কামনা করছে অগ্নিদেব। ভৃগুর স্ত্রী পুলোমাকে কামনা করছে রাক্ষস( তারও নাম পুলোমা)। বান্ধবী দেবযানীর স্বামী যযাতিকে কামনা করছে শর্মিষ্ঠা।
গ্রিক পুরাণেও দেখি প্রায় একই ঘটনা। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি। স্বামী তার দেবকারিগর খঞ্জ ও কুৎসিত হেফাস্টাস। স্বামী থাকা সত্ত্বেও আফ্রোদিতি সমানে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন রণদেবতা এ্যারেস ও বার্তাবাহী দেবতা হার্মিসের সঙ্গে। স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমে ক্ষুব্ধ হেফাস্টাস এমন এক খাট বানালেন যেখানে ফাঁদে আটকে গিয়ে ধরা পড়লেন প্রেমিকযুগল আফ্রোদিতি ও এ্যারেস। মানুষও বাদ যাচ্ছে না দেবীর প্রেমিক হওয়ার গৌরব থেকে। এ্যাডোনিস, অ্যাংকাইসিজসহ অনেক মর্ত্যমানব আর টাইটানই দেবীর প্রেমিক। যতই প্রেম করুন দেবীত্বের মহিমা কিন্তু ক্ষুণ্ন হচ্ছে না। পরের স্বামী ও প্রেমিকের দিকে নজর দিচ্ছেন অন্য দেবীরাও। ঊষাদেবী ইওস টাইটান আস্ত্রেউসের বিবাহিত স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও মর্ত্যমানব সিফালাসকে কামনা করছেন। এ্যারেসের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ছেন। পাতালদেব হেডিসের স্ত্রী দেবী পার্সিফোনে কামনা করছেন এ্যাডোনিসকে। হেসিওডের থিওগনি, হোমারের ইলিয়াড অডিসি আর ভার্জিলের ইনিদে রয়েছে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের রকমারি কাহিনি।
গ্রিক আর বৈদিক- দুই পুরাণের দুই দেবরাজ পরনারী গ্রহণে সিদ্ধহস্ত। জিউস আর ইন্দ্র দুজনেই অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে নাকাল হয়েছেন একাধিকবার। গৌতমের স্ত্রী অহল্যা, দেবশর্মার স্ত্রী রুচির প্রতি ইন্দ্রের আসক্তি গোপন ছিল না স্বামীদের কাছেও। স্পার্টার রাজা টিন্ডারিউসের স্ত্রী লিডা ছিল জিউসের প্রেমিকা। মহাসাগররাজ পোসাইডনও পরস্ত্রীর প্রতি কম আসক্ত ছিলেন না। তবে তাদের দেবত্ব কিন্তু খারিজ হয়নি তাতে মোটেই।
বাইবেলেও দেখি পরস্ত্রী বাথসেবার প্রেমে পড়াতে ডেভিডের মহিমা মোটেই কমেনি। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে এগুলোকে কি প্রেম বলা যায়? নাকি শুধুই কামনা? দেহের খেলা? মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেন আর ইনোনির স্বামী প্যারিসের ট্রয়জ্বালানো প্রেমের কথাই ধরা যাক। হেলেন আর প্যারিসের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের কথা বলেছেন পরবর্তী কালের কবিরা, হোমার নন। ইলিয়াডে হেলেন প্যারিসের সঙ্গে গৃহত্যাগ করার জন্য নিজেই বারে বারে দোষ চাপিয়েছে আফ্রোদিতির ঘাড়ে। বলেছে, নিজের ইচ্ছায় নয়, দেবীর মায়ায় বা ছলনায় তার এই ‘ভুল’। প্যারিসের মৃত্যুর পর হেলেন প্রথমে হয় দেবর ডাইফোবাসের স্ত্রী। তারপর ফিরে যায় মেনেলাউসের ঘরে।
আধুনিক ভালোবাসা অর্থে যে পরকীয়া প্রেম, সাহিত্যে তার দেখা পাওয়া যায় মূলত মধ্যযুগে। নারীর পায়ে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতির শক্ত শিকল। স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের দিকে তাকানো পাপ। ‘পরদারেষু’ তখন ‘মাতৃবৎ’। বিবাহিত পুরুষের কিন্তু তখন কুমারী কন্যার দিকে তাকানোতে বাধা নেই। না সমাজে, না সংসারে।
মঙ্গলকাব্যে ঘরে স্ত্রী লহনাকে রেখে দিব্যি খুল্লনাকে বিয়ে করছে ধনপতি সওদাগর। পদ্মাবতীতে সিংহলের সুন্দরী রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে চলেছে চিতোরের রাজা রত্ন সেন। ঘরে কিন্তু তার এক স্ত্রী রয়েছে। সে সময় পুরুষ বিবাহিত অবিবাহিত যাই হোক সমস্যা নেই। নারীটি কারও ঘরণী হলেই মুশকিল।
তবে শিকল যত শক্ত তা ভাঙার ইচ্ছা ততই প্রবল। মধ্যযুগে তাই সব দেশের সাহিত্যেই পরকীয়া প্রেমের জয়জয়কার। শিরী ফরহাদ, ইউসুফ জোলেখা, কোনো কাব্যেরই নায়িকা স্বকীয়া নয়। বৈষ্ণব পদাবলীর ছত্রে ছত্রে রাধার আকুতি। শাশুড়ি জটিলা, ননদী কুটিলার শ্বেনদৃষ্টি, প্রতি পদে বাধা। তবু অভিসার, তবু বাঁশির অপেক্ষা। আবার মোহনীয় কালার প্রতি ক্ষোভেরও অন্ত নেই। না শুধু দেহ নয়, মনই বটে। এই প্রেম ‘নিকষিত হেম’। পদকর্তা চ-ীদাসের নিজের আকুতিও রয়েছে বিবাহিতা রজকিনীর প্রতি।
যমুনার তীরই হোক আর পারস্যের গোলাপ বাগান। একই মর্মবেদনা বাদশাহ খসরুর স্ত্রী শিরীর, শিল্পী ফরহাদের জন্য। সমুদ্রের অপর পাড়ে ইউরোপেও তখন সাহিত্যে চলছে পরকীয়া বন্দনা। রাজা আর্থারের স্ত্রী রানী গুইনিভেরার সঙ্গে রাউন্ডটেবলের বীর নাইট স্যার ল্যান্সলটের কালজয়ী প্রেম ইংরেজি সাহিত্যের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে।
ত্রিস্তান আর ইসল্টের প্রেমকাহিনি তো ভুবন বিখ্যাত। অনেক চারণকবির রচনায় এই প্রেম কাহিনি হয়েছে গীত। রাজা মার্কের স্ত্রী কর্নওয়ালের রানী ইসল্ট আর রাজা মার্কের ভাগ্নে বীর নাইট সুদর্শন ত্রিস্তান। টিন্টাজেল দুর্গে তাদের প্রেম অভিসার। পরিণতি অবশ্যই বিয়োগান্ত।
মহাকবি শেকসপিয়ার অ্যান্থোনি ও ক্লিওপেট্রা নাটকে মানব মনের রহস্য উন্মোচনে যে প্রেমের ছবি এঁকেছেন তাও মূলত বিবাহ বহির্ভূত প্রেমেরই। ক্লিওপেট্রার প্রেমে গভীরভাবে আবদ্ধ হয়েও অক্টাভিয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য হন অ্যান্থোনি। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আবার ফিরে যান ক্লিওপেট্রার কাছেই। অ্যান্থোনি বিবাহিত পুরুষ একথা জানা সত্ত্বেও সিজারের বিধবা পত্নী ও মিশরের রানী ক্লিওপেট্রা তাকে ভালোবাসতে কুণ্ঠিত হন না মোটেই।
মধ্যযুগে নিষেধাজ্ঞা ছিল শুধু বিবাহিত নারীর বেলায়। আধুনিক যুগে এসে নীতির বেড়ি পুরুষের পায়েও পড়েছে। শিল্পের খাতিরেও তাই বিবাহিত গোবিন্দলাল আর বিধবা রোহিণীর প্রেমকে সমর্থন করতে পারেনি বঙ্কিমের নৈতিকতা। রোহিণীকে তো জীবন দিতে হলোই শান্তি পেল না গোবিন্দলালও। কৃষ্ণকান্তের উইলের মতো একইভাবে সূর্যমুখীর স্বামীকে ভালোবেসে মরতে হলো বিষবৃক্ষের কুন্দনন্দিনীকে। এ যেন অনেকটা গুরুমশায়ের দ- ‘দেখ, অবৈধ প্রেম করিলে কী শাস্তি ভোগ করিতে হয়’।
তবে অতোটা কঠোর হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। চোখের বালিতে আশার স্বামী মহেন্দ্রর প্রেমে পড়ে যতই অপরাধ করুক বিনোদিনী কিংবা ঘরে বাইরে উপন্যাসে সন্দীপের জন্য বিমলার অনুভূতি অনৈতিক হোক না হোক তাই বলে জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কেন? আর নষ্টনীড়ের চারুকে তো ছাড়তে হয়নি কিছুই-না কুল না সংসার। একরাত্রি গল্পের সুরবালাও অপরের স্ত্রী। তবু তার জন্য যে দীর্ঘশ্বাস তাতে নীতি শাস্ত্রের গায়ে আঁচ লাগছে না একবিন্দুও। আসলে সমাজ সংসার থেকে পরকীয়ার বিষবৃক্ষকে উৎপাটনের যত চেষ্টাই সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম করুন, এ যে আছে, এর শিকড় যে অনেক গভীর, একে যে অস্বীকার করা যায় না মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেছিলেন হয়তো বা নিজের জীবন থেকেই। আর তাই অকালমৃত নতুন বৌঠান কাদম্বরীর ছায়া পড়েছে তার অসংখ্য গল্প কবিতায়। নিজের সৃষ্টির মধ্যেই প্রেয়সীকে অমর করেছেন তিনি।
প্রেমের রেলগাড়ি যে সর্বদা লাইন মেনে চলবে না তা শরৎচন্দ্রেরও অজানা ছিল না। গৃহদাহতে তাই প্রেমিক এবং পরবর্তীতে স্বামী মহিমের প্রতি যথেষ্ট ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সুরেশের প্রতি যে আন্তরিক আকর্ষণ অচলার ছিল তাকে দোষ দিতে পারেননি শরৎবাবু। পরস্ত্রী হলেও অভয়ার জন্য তরুণ রোহিণীর অকৃত্রিম ভালোবাসা এমনকি দুজনের একসঙ্গে বসবাসকে শ্রীকান্ততে তিনি নিন্দা তো করেনইনি প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। সমাজ কিংবা সংসারের বাঁধাধরা নিয়ম কানুনের চেয়ে তার কাছে অনেক বেশি আবেদন রেখেছে তাদের ভালোবাসা এবং তথাকথিত অবৈধ সম্পর্ক।
পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো প্রখ্যাত লেখক নেই যিনি সৃষ্টিকর্মে পরকীয়ার ছবি আঁকেননি। তারাশঙ্করের হাঁসুলীবাকের উপকথার বিবাহিত পাখি সমাজের চোখ রাঙানিকে অস্বীকার করে ভালোবাসে সুজনকে। কবি উপন্যাসের নিতাই, ঠাকুরঝিকে ভালোবাসে ঐকান্তিক আবেগে। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝিতে মালার স্বামী কুবের ভালোবাসতে দ্বিধা করে না বিবাহিত শ্যালিকা কপিলাকে। বিমল মিত্রের স্ত্রী উপন্যাসে জমিদারের পারিষদ সীতাপতি জমিদারপত্নীর সঙ্গেই জড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার বন্ধনে। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের উপন্যাসত্রয়ী কলকাতার কাছেই, উপকণ্ঠে আর পৌষ ফাগুনের পালায় রয়েছে দেবর নিত্যপদের সঙ্গে ভাতৃজায়া নির্মলার তীব্র প্রেম। মাসতুতো ভায়ের স্ত্রী রাণী বৌদিকে দেখে মুগ্ধ ও দেহাতীত প্রেমে মগ্ন হেমকান্তি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়ের বিবাহিত গঙ্গানারায়ণ তীব্রভাবে ভালোবাসে বিধবা বাল্যসখী বিন্দুবাসিনীকে। শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজনে বিবাহিত লীলাবতীকে নিয়ে ঘর ছাড়ে শিল্পী। সৈয়দ শামসুল হকের পরাণের গহীন ভিতরের ছত্রে ছত্রে পরকীয়ার ছায়া। হুমায়ুন আহমেদ, রাহাত খান, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, নাসরীন জাহান, মইনুল আহসান সাবের- পরকীয়ার ছবি তাদের গল্পে এঁকেছেন।
পাশ্চাত্যের অসংখ্য লেখক তাদের লেখায় এঁকেছেন পরকীয়ার ছবি। তবে সবচেয়ে বেশি চিত্রিত হয়েছে সম্ভবত, মোপাসাঁর গল্পে। তাঁর অনেক গল্পেরই নায়িকা অন্যের স্ত্রী। কিংবা নায়ক বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অন্য নারীতে আসক্ত। অনেক ক্ষেত্রে এই বিয়ে বহির্ভুত সম্পর্কগুলোকে প্রেম মনে না হয়ে লাম্পট্য বলে মনে হতে পারে। যেমন ‘বেলামি’ উপন্যাসে নায়ক দুরয়ের ভালোবাসা। সাংবাদিক দুরয় বহু নারীতে আসক্ত সবাই তারা পরস্ত্রী। সুদর্শন দুরয়ের প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে না সমাজের হোমড়া চোমড়াদের স্ত্রীরাও। সুদর্শন চেহারা আর রমণীমোহন বাকপটুতার জোরে দুরয় অনায়াসে জয় করে নেয় তার পত্রিকার সম্পাদক এবং পত্রিকা মালিকের স্ত্রীর প্রেম। কিন্তু সত্যিকারভাবে সে ভালোবেসে ফেলে স্ত্রীর বান্ধবী মাদাম মেরিলিকে। মাদাম মেরিলিও বিবাহিতা। স্বামী থাকা সত্ত্বেও তিনি বান্ধবীর স্বামী দুরয়কে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবাসেন। তবে মঁপাসা তাদের ভালোবাসা যত আন্তরিকতার সঙ্গেই আঁকতে চেষ্টা করুন না কেন, অতিরিক্ত বহুগামিতার কারণে এক পর্যায়ে দুরয়কে ফন্দিবাজ লম্পট বলেই মনে হয়, প্রেমিক নয়।
একইভাবে লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার এবং ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি প্রেমের চেয়ে অবৈধ দেহজ সম্পর্কের দলিল বলেই বেশি পরিস্ফূট। তবে মোপাসাঁর আরেকটি উপন্যাস স্ট্রং এ্যাজ ডেথের নায়ক শিল্পী অলিভার যে বিবাহিতা মাদাম গিলেরয়ের প্রেমে পড়ে এবং প্রায় সারাজীবন তার প্রতিই অনুরুক্ত থাকে তা সত্যিই প্রেম–গভীর এবং নিখাদ।
পাশ্চাত্য সাহিত্যে পরকীয়ার কথা যখন উঠল তখন একটি মেয়ের গল্প শুনুন। সুন্দরী সুশিক্ষিতা এই তরুণী এক প্রাজ্ঞ কূটনীতিকের স্ত্রী। সমাজে তার দারুণ প্রতিপত্তি, সুনাম, প্রতিষ্ঠা। একদিন মস্কো রেল স্টেশনে তার সঙ্গে দেখা হল এক তরুণ সামরিক অফিসারের। আর তারপর থেকে তাদের জীবন গেল একেবারে বদলে। কিন্তু পৃথিবীতে তো শুধু তারাই নেই। আছে তরুণীর স্বামী, শিশুপুত্র। আছে সমাজ, সংসার, আর আছে সমাজের কিছু অমোঘ নিয়ম কানুন। সেই সঙ্গে রয়েছে নিজেদের সম্পর্কের জোয়ার ভাটা,ভালোবাসার অনিবার্য কিছু দাবি। ঠিকই ধরেছেন, এ গল্প পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস–লেভ তলস্তয়ের আনা কারেনিনার। আনা আর কাউন্ট ভ্রনস্কির জীবনের গল্প।
পরকীয়ার পিছনের কারণ হিসেবে অনেক সাহিত্যিকই তুলে ধরেছেন যৌনজীবনে অতৃপ্তি, বিবাহিত জীবনে একঘেঁয়েমি, বৈচিত্র্যের তৃষ্ণাকে। অনেকটা সেই মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত চলচ্চিত্র সেভেন ইয়ারস ইচ এর মতো।
বিবাহিত জীবনের অতৃপ্তি, হতাশা তো রয়েছেই। রয়েছে যা পাইনি তা পাবার আকাক্সক্ষা আর সেই সঙ্গে স্বপ্নপুরুষ বা স্বপনচারিণীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার বিরল সংযোগ। বহু উপন্যাসে দেখা গেছে শুধু অসুখী দাম্পত্য নয়, অনেক সুখী নীড়ও কেঁপে যায় পরকীয়া ঝড়ে।
সম্প্রতি এক বন্ধু ‘ভদ্রলোক’ শব্দটির নতুন সংজ্ঞা দিলেন। সুযোগ পেয়েও পরের সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে যিনি ফষ্টি নষ্টি করেন না, তিনিই নাকি প্রকৃত ভদ্রলোক। তবে ফষ্টি নষ্টি বা ফ্লার্ট আর প্রেমের মধ্যে পার্থক্য প্রচুর। আন্তন চেখভের দুটি সুবিখ্যাত গল্পের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ছে। ‘প্রজাপতি’ আর ‘কুকুর সঙ্গী মহিলা’। প্রজাপতির নায়িকা কারও প্রেমে পড়ার জন্য ছিল ব্যগ্র। স্বামীকে তার মনে হতো একেবারে সাদা মাটা ধরনের পুরুষ। কিন্তু শত চেষ্ট সত্ত্বেও অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে প্রেমের ভাগ্য তার হয়নি। যে সম্পর্কগুলোকে সে ভালোবাসা ভেবেছিল সেগুলোতে হালকা আবেগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার প্রকৃত ভালোবাসা ছিল স্বামীর প্রতিই।
কুকুর সঙ্গী মহিলা গল্পের নায়িকা আন্না সের্গেভনার বেলায় ঘটে একেবারে উল্টো ঘটনা। বিবাহিত আন্না গল্পের নায়ক গুরভের( সেও বিবাহিত) সঙ্গে সম্পর্কটিকে নিয়েছিল ফ্লার্ট বা ফষ্টিনষ্টি বা একেবারে হালকা আবেগ হিসেবে। পরে দুজনেই উপলব্ধি করে যে সেটিই ছিল তাদের জীবনের গভীরতম প্রেম।
ইংরেজিতে একটি কথা প্রচরিত আছে, ‘লাইফ ইজ মিটিং রাইট পারসন ইন দ্য রং টাইম। এই নিতান্ত ভুল সময়ে সঠিক মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার ঘটনা বা দুর্ঘটনাই পরকীয়া প্রেম। অনেক গ্রিক নাট্যকারই প্রাণপণে যাকে ‘পাপ’ বলতে চেয়েছেন ( আগামেমনন, ইলেকট্রা সব নাটকেই যাবতীয় অঘটনের মূলে রয়েছে পরকীয়া পাপ)।
কিন্তু পরকীয়া তো নিছক লাম্পট্য নয়, স্রেফ ব্যাভিচারও নয়, হৃদয়ের ব্যাপার স্যাপার তো জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। আর হৃদয়ের ব্যাপার যতদিন রয়েছে ততোদিন মানব সমাজে এর অস্তিত্বও রয়েছে। সাহিত্য তো মানুষের কথাই বলবে। সাহিত্যে পরকীয়ার ছবির তাই শেষ নেই।
অতীতের মতো ভবিষ্যতেও কাহিনিতে, গানে, কবিতায়, শিল্পীর তুলিতে মূর্ত হবে অধরা মানুষের কথা। শিল্প সর্বদাই বলবে মানব জীবনের কথা, ভালোবাসার কথা। সে ভালোবাসা বিবাহ বর্হিভূতও হতে পারে। হতে পারে বিবাহিত গণ্ডির ভিতরেও।