“না, সাহারা আপা, আপনাদের ভোলা যাবে না কোনদিন”

By: নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ২০২০-০৭-১০ ১০:২০:৫২ এএম আপডেট: ২০২৪-০৫-০৪ ৩:৫৭:১৪ এএম মতামত
সাহারা খাতুন

সাহারা খাতুন। আমাদের নাটকের মানুষের 'সাহারা আপা' গতকাল চলে গেছেন না ফেরার দেশে।বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের কথা বলতে গেলে যেমন মহিলা সমিতির কথা, ড: নীলিমা ইব্রাহীমের কথা, আইভি রহমানের কথা বলতে হয়। ঠিক তেমনি বা কিছুটা বেশী চলে আসে সাহারা খাতুনের নাম।

১৯৭৪ সালে যখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ঢাকা থিয়েটার ,থিয়েটার ও বহুবচন মহিলা সমিতি মঞ্চে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করছে, তখন সাহারা খাতুন মহিলা সমিতির নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে সেই পুরানো মহিলা সমিতি’র ভবনে নিয়মিত অফিস করেন। আমরা যারা মুক্তি যুদ্ধোত্তর সেই কালে মহিলা সমিতিতে মাত্র ৳১৫০/টাকায় মিলনায়তন ভাড়ার বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন করছি, সে সময় প্রদর্শনীর প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে অর্জিত অর্থই আমাদের প্রযোজনা ব্যয় মিটানোর মূল উৎস। ৫.০০- ১০.০০ টাকা প্রবেশ মূল্য। সর্ব সাকুল্যে ৩০০ চেয়ার। তার মধ্যে ৮-১০ চিয়ার ভাঙ্গা। মিলনায়তন পূর্ণ হলে ১৪০০-১৮০০ টাকা প্রাপ্তি। একসাথে সারা মাসের হল বরাদ্দ হতো তখন। চারদিন বা ছ’দিন বরাদ্দ পেতাম। একসাথে হয়তো ছ’দিনের হলভাড়া দেয়া সম্ভব হত না নাট্যদলের। শুরু হত দেন দরবার। সাহারা আপা বলতেন “ভাই বুঝেন না কেন ! এই হল ভাড়াতেইতো আমাদের পুরো এই সমিতির কার্যক্রম চালাতে হয়। অস্বচ্ছল বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্ত  নারী, নিপীড়িত নারী এদেরকে আমরা স্বাবলম্বী করার যে কার্যক্রম চালাচ্ছি তাতো আপনারা দেখতেই পান। তার খরচ আছে না। মিলনায়তন ও অফিস কর্মচারীদের বেতন ভাতা সবতো ঐ মিলনায়তন ভাড়ার উপর নির্ভরশীল”! আমরা হয়তো কিছু টাকা পরিশোধ করেছি আর বাকীটা শো’য়ের পরপরই দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাহারা আপাকে রাজি করিয়ে ফেলতাম। 

আমাদের ঢাকা থিয়েটার’র নাটকগুলো ১৯৮০ থেকে যখন প্রসিনিয়াম ভেঙ্গে মিলনায়তনের চৌকোন মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো তখন মহিলা সমিতির কতৃপক্ষের অভিযোগ চেয়ার সড়াতে টানাহ্যাঁচড়া করে আমরা অনেক চেয়ার ভেঙ্গে ফেলছি। সুতরাং মঞ্চ ছাড়া নাটক করা যাবে না। সালিশ বসলো নীলিমা আপা, আইভি আপা, সেলিনা আপা ও সাহারা আপা উপস্থিতিতে। আসামী হিসাবে আমি উপস্থিত। সাথে রামেন্দু মজুমদার। সভানেত্রী নীলিমা ইব্রাহীম ও সাধারণ সম্পাদক আইভি রহমান জানতে চাইলেন বিষয়টি নিয়ে। অভিযোগকারীর নাম উল্লেখ না করে আলোচনা শুরু হলে আমি আমার মিলনায়তনে দর্শেকের বসার স্থানে নাটক করার শৈল্পিক প্রয়োজনের যুক্তি তুলে ধরি। রামেন্দু দা আমাকে সমর্থন করলেন। সাহারা আপার অভিমত চাইলে তিনি বলেন- “হ্যা। ক’টা চেয়ার ভেঙ্গেছে। এগুলো ঠিক  করে দিতে হবে বাচ্চু ভাইদের”। আমি নড়েচড়ে বসি। তিনি আরো বলেন, “সবাই যদি এইভাবে মঞ্চ ছেড়ে নাটক মেঝেতে করে, তবেতো মেঝটাও শেষ হয়ে যাবে।” নীলিমা আপা বলেন, 
“সেতো বুঝলাম। কিন্তু নাটক মঞ্চ ছেড়ে কেমন হচ্ছে ?” সাহারা আপা একটু পজ নিয়ে বল্লেন, “ভালো! শুধু ভালো না অভিনব। আমার খুব ভালো লেগেছে!”

নীলিমা আপা হেসে বল্লেন, “তাহলেতো ঠিক আছে। নাটক ভালো হলেতো কথা নাই। তবে সম্পদ  বিনষ্টের দায়িত্ব নাট্যদলটিকে নিতে হবে।”

সাহারা আপা হেসে বলেন, “ভাই আপনাদের নাটক দেখে যে কি ভালো লাগে। নূতন নাটকের শো শুরুর পরপরই আমি পেছনের একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ি। নাটক দেখি। চোখে পানি চলে আসে। আহা! এত সুন্দর নাট্যআন্দোলনে মহিলাসমিতি মানে আমদের একটা ভূমিকা আছে। এইটাতো একটা বড় আনন্দের”। 

এই হলো সাহারা আপা।

আর নীলিমা আপার স্নেহ আর আইভি আপার ভালোবাসা না থাকলে আমাদের নাট্যচর্চা সেসময় এভাবে বেগবান হতোনা।

বিদ্যুৎ, পানি গ্যাস’র আকালের সেদিনগুলোতে সাহারা আপা কি ধৈর্য্যের সাথে মহিলা সমিতির কার্যক্রম চালু রেখেছেন, নাট্যচর্চা অব্যহত রাখতে সহযোগিতা করতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো না তাঁর এবং আমাদের প্রিয় তারামিয়ার (পিয়ন)। এবং সপ্তাহে সাতদিন সাহার আপার বকা তারা মিয়ার কপালে ছিলো। অবশ্য সে স্নেহও পেয়েছে অপার। প্রতিদিন শতশত দর্শকের আগমনে মুখরিত মহিলা সমিতি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ও সেবা নিশ্চিত করা এক দূরহ কাজ। সেই কাজটি তিনি, তারা মিয়া ও অন্যান্য কর্মীদের দিয়ে সুচারুভাবে করিয়েছেন। তাই তাঁর কোন অবসর ছিলো না। সপ্তাহে ছ’দিন সেলাই অন্যন্য প্রশিক্ষণ চলতো। সে কাজটিও তিনি ইর্ষনীয় সাফল্যের সাথে করেছেন। 

আজ সাহারা আপা চলে গেলেন। নীলিমা আপা চলে গেছেন বহুকাল আগে। আইভি রহমানকেতো হত্যা করেছে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী, ২১ আগষ্ট ২০০৪সালে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত জঙ্গী হামলায় আরো ২২ জনের সাথে আইভি আপা শহীদ হন। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। তারামিয়া চলে গেছে। সেতো একযুগেরও বেশী সময়। আলোর অপরিহার্য্য নাম সিরাজ মিয়াও আমাদের ছেড়ে গেছেন। রূপ সজ্জার সালাম ভাই, বঙ্গজিৎ দাসহ অনেক রূপকারতো চলে গেছেন অনন্তের পথে। বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনের সোনালী যুগের সোনালী মানুষেরা চলে যাচ্ছেন একএক করে। 

নাটক এখন মহিলা সমিতি ছেড়ে নতূন আবাস গেঁড়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্য শালায়।

কিন্তু আমরা কি আমদের সোনালী সময় (১৯৭২-২০০০)’র সোনালী মানুষদের ভুলতে পারবো কোনদিন।

না, সাহারা আপা, আপনাদের ভোলা যাবে না কোনদিন। আপনার মতো সৎ ত্যগী নিরলস পরিশ্রমী রাজনীতিবিদ ও সমাজ কর্মীকে কেমন করে ভুলবে বাংলাদেশ।

আপনার প্রতি বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের  শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।

 


নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, নাট্য ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও শিল্প সংগঠক।