এন্ড্রু কিশোরের কালজয়ী সাত গানের গল্প

By: সুখবর ডেস্ক ২০২০-০৭-০৬ ১০:১০:০৭ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-২০ ৯:২৭:২১ এএম তারকা
সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর, মিনু বাড়ৈয়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় এক শিশু। প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামে তাঁর সদ্যোজাত সন্তানের নাম রাখলেন ‘কিশোর’। সেই ছেলেটি বড় হয়ে সঙ্গীতাঙ্গনে পা রাখলো একদিন। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন আটবারের চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই বরেন্য শিল্পী। অতঃপর ৬ জুলাই সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় তার বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

আশির দশকে প্লেব্যাক জগতে পা রাখার পর থেকে বাংলা, হিন্দিসহ বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার বহুসংখ্যক গান স্থান করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতির মণিকোঠায়। শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন সারা জীবন গুনগুন করে যাবার মতো কিছু গান, যেসব গানের অনেকগুলোই আমরা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, যৌবন-তারুণ্যের দিনগুলোতে শুনেছেন আমাদের বাবা-চাচা, মা-খালারা! তেমনই কিছু কালজয়ী গানের পেছনের গল্প তুলে ধরা হলো।


১. হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস

এই গানের জন্য এন্ড্রু কিশোর প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৮২ সালে। ‘বড় ভাল লোক ছিলো’ সিনেমার গান এটি। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এর রচয়িতা। আলম খানের সুর।  সৈয়দ শামসুল হক গান লিখতেন না তখন। এই ফিল্মের প্রোডাকশন ‘শাওন সাগর’ ওই সময়ের নামকরা হাউসগুলোর একটি। তাদের অধিকাংশ সিনেমাই ছিল নান্দনিক ও বার্তা বহনকারী। এই সিনেমার পরিচালক মহিউদ্দিন একজন নামকরা প্রফেসর ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতো। বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে উনি পুরস্কার পান এবং সম্মানও পান। আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবিটি। সে হিসেবে সৈয়দ শামসুল হককে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল।

একদিন গানটি নিয়ে উপস্থিত হলেন সৈয়দ শামসুল হক। গানটি দিয়ে বললেন,  ‘আলম সাহেব গান তো লিখতে বলেছেন। কিন্তু গান তো লিখি না আমি। লিখতে চাইও না। কারণ, যাই লিখতে যাই তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন লিখে শেষ করে ফেলেছেন! আর যদি নতুন কিছু না দিতে পারি, তাহলে তো লিখে লাভ নেই। আমি অনেক চিন্তা করে একটা ছোট্ট জিনিস লিখে এনেছি, জানি না এটা আপনার কেমন লাগবে। তবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউই এই শব্দগুলো তাঁদের গানে ব্যবহার করেননি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য। কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয়নি। আপনি যদি আমার চাওয়ামতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আর আপনি যাঁকে দিয়ে গাওয়াবেন, তাঁর ১০০ পার্সেন্ট লাগবে না, ৬০ পার্সেন্টও যদি গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে নিশ্চিত।’

সৈয়দ শামসুল হকের সব কথাই সত্যি ফলে গিয়েছিল। পরে যখন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোরের দেখা হলো, তখন তাঁরা দুজনই একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁদের কথা হলো, তাঁরা দুই গীতিকার সেই সাম্রাজ্যবাদের পর থেকে আধুনিক গান নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, তবুও এসব শব্দ তাঁরা খুঁজে পাননি এবং যাদেরকে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ভাবা হয়, তাঁরাও এসব শব্দের ব্যবহার করেননি। ‘তো, এই গীতিকার ছেলেটি কে?’ প্রশ্ন করলেন। এন্ড্রু কিশোর হেসে বললেন, ‘ছেলেটা না, উনি একজন ভদ্রলোক। আমাদের দেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।’

 

 


২. এক চোর যায় চলে

১৯৭৮ সাল। আলম খানের সুরে ‘প্রতীক্ষা’ সিনেমার গান এটি। এন্ড্রু কিশোরের রেকর্ড করা তৃতীয় গান।  কিন্তু রিলিজ হওয়া প্রথম গান। গানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আর যেটা এন্ড্রু কিশোর প্রথমে গেয়েছিলেন, সেটা রিলিজই হয়নি। এদিকে, শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ‘তিন কন্যা’ সিনেমাটিতে যখন গান হয়, তখন কলকাতায় বাংলাদেশের তিন সংগীত পরিচালক- আলাউদ্দিন আলী, সুজেয় শ্যাম আর আলম খান কাজ করছিলেন। এন্ড্রু কিশোরেরও সেখানে গান গাওয়ার কথা, কিন্তু  মধ্যপ্রাচ্যে একটা শো করতে গিয়ে পাসপোর্ট জটিলতায় সেখানে প্রায় ২০/২৫ দিন আটকে গেলেন। পরে  দেশে এসে বাসায় একটি চিঠি পেয়ে ইন্ডিয়ান ভিসা করে কলকাতায় গেলেন। সেখানে গান নিয়ে তাঁর জন্য তিনটি পার্টি অপেক্ষা করছিলো। যেতে দেরি হওয়ায় কেদার ভট্টাচার্য নামের এক শিল্পী এরই মধ্যে ‘তিন কন্যা’ ছবির গান গেয়ে ফেলেছেন, যিনি পরবর্তী সময়ে ‘কুমার শানু’ নামে পরিচিতি পান। সুজেয় শ্যামদার একটা-দুটা গান গাওয়ার পর তৃতীয় গানটা গাওয়ার জন্য যখনই শানু প্রস্তুত, তখন এন্ড্রু কিশোর গিয়ে স্টুডিওতে হাজির হলেন। এন্ড্রু কিশোরকে দেখে একজন বললেন, ‘আমাদের শিল্পী  এন্ড্রু চলে এসেছে, ওই ছেলেরে বের করে দাও।’ কিশোর বললেন, ‘না, এটা হতে পারে না। উনি একজন  শিল্পী। আমি তো এটা করতে পারি না।’ কুমার শানু তখন বাইরে এসে বলল, ‘তোমারই গান দাদা, প্রডিউসার চাইছে, তুমি গান গাইবে না কেন? আমি তোমার তিন-চারটা গান গেয়ে ফেলেছি দাদা। আমার আর দরকার নেই। আমার জীবনে রেডিওতে গান গাইনি, কোথাও গান গাইনি। তোমার দেরি হওয়ায় সিনেমায় প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ব্যস, মেরে দিলাম।’ এই কথা কিন্তু কুমার শানু আজো মনে রেখেছে। পৃথিবীর যে জায়গাতেই এন্ড্রু কিশোর গিয়েছেন, শানু নিজে থেকে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন। 

 

 


৩. আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি

১৯৮৪ সালের কথা। ‘নয়নের আলো’ ছবির গান এটি। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রথম পুরো একটি সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। শুধু তাই নয়, পুরো সিনেমার গানের গীতিকার, সুরকারও তিনি। প্রযোজক ছিলেন ফরিদ সাহেব। খুবই ভদ্রলোক। একদিন তাঁর অফিসে ডাকলেন এন্ড্রু কিশোর আর আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। গিয়ে তারা দেখেন, সিনেমার পরিচালক বেলাল আহমেদ বসা। ফরিদ সাহেব বললেন, ‘এন্ড্রু তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ছেলে।  জানো, আমি লেখাপড়া শিখে এই সিনেমার লাইনে এসে খুব ভুল করেছি। আমার ছেলেমেয়েরা বলে, কী সব আজেবাজে ছবি তোমরা বানাও। বলতে তাদের নাকি লজ্জা লাগে। খুব চিন্তা করে দেখলাম। বয়স তো হয়ে গেছে, এখন এমন ছবি একটা বানাতে চাই, যে সিনেমার নাম আমার ছেলেমেয়েরা একটু গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে- এই সিনেমার প্রযোজক আমার বাবা।’ সে উদ্দেশ্য নিয়েই ছবিটা বানানো।

সবকিছুই নতুন চান ফরিদ সাহেব এই ছবিতে। পুরোনো কেতাদুরস্ত গল্প, পুরোনো অভিনেতা নিয়ে কাজ করবেন না বলে জানালেন তাঁরা। সে জন্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। তিনি এর আগে ‘নাগরদোলা’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে কিছু কাজ করেছিলেন। বুলবুল ভাই সিলেক্ট করলেন এন্ড্রু কিশোরকে।

এই গানের যেদিন রেকর্ডিং ছিল, সেদিন  এন্ড্রু কিশোরের গলার অবস্থা খারাপ। তিনি বললেন, ‘আজকে ভয়েস খারাপ, অন্য একদিন ভয়েস দিই।’ তখন মিউজিক ট্র্যাক শুরু হয়েছে কেবল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বললেন, ‘না না, টাইম নাই। আজকে গাও। আজকে গানের মুডে আছি, তুমি গাও।’ কিশোর বললেন, ‘গানের মুডে আছেন ঠিক আছে, কিন্তু আমার তো গলার অবস্থা ঠিক নাই।’ বুলবুল বললেন, ‘অসুবিধা নাই, তুমি গাও।’ তারপর এন্ড্রু কিশোর গানটি গাইলেন। গাওয়ার পর কিশোর গানটি আরেকদিন করবেন বলে অনুরোধ করতেই বুলবুল বললেন,‌ ‘শোনো এন্ড্রু, তুমি তো গাইছো গান, কিন্তু আমার চোখে তো পুরো ছবিটা। ছবিতে একটা  ছেলের বাবা মরে যাওয়ার পর তার মনের যা অবস্থা, তার মনে যে উথালপাথাল ঢেউ, তা-ই ফুটতে হবে। তখন সেই ছেলের গান তো পুরোপুরি সুরে হবে না। সেই গান একটু ক্রেক করবে, ভুল থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। ১০০ ভাগ গাইতে পারলে তো ওই ছেলের ভেতরে দুঃখ নাই। এই যে একটু একটু ভুল আছে, এটাই আমার দরকার। এটাই ওকে। আর এটা স্ক্রিনে আমার রেজাল্টও দেবে।’ এন্ড্রুর গলা খারাপ ছিল বলে ওই খুঁতগুলো রয়ে গিয়েছিল, যা পরে সিনেমার প্রয়োজনে শাপে বর হয়।

 


৪. আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে 

এটিও ‘নয়নের আলো’ ছবির গান। প্রযোজকের কথামতো আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের তখন নতুন নারী কণ্ঠ দরকার। এন্ড্রু কিশোর, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলেকে সামিনা চৌধুরীর কথা বললেন। সামিনা চৌধুরির তখন ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’ এবং ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’ গানগুলো রিলিজ  হয়েছে। তারপর একটা গিটার নিয়ে এন্ড্রু কিশোর আর বুলবুল রিকশা করে সামিনা চৌধুরিদের মোহাম্মদপুরের বাসায় গেলেন। তখন সামিনা চৌধুরির মা, (শিল্পী মাহমুদুন্নবীর স্ত্রী) বললেন, ‘না, আগে আমি গান দেখব, তারপর সিদ্ধান্ত।’ এতে বুলবুল ভাই কিছুটা রাগ করে এন্ড্রু কিশোরকে বললেন, ‘চলো, আর গান করা লাগবে না।’ ইমতিয়াজ বুলবুলের ইগোতে লেগেছিল- ‘আমি তাকে সিনেমায় গান গাওয়াতে এসেছি। আর উনি বলছেন গান দেখবেন?’ এন্ড্রু কিশোর বুলবুলকে বুঝিয়ে বসালেন। তারপর গানটা দেখে সামিনা চৌধুরির মায়ের পছন্দ হলো। বলে রাখা দরকার যে, সামিনা চৌধুরী কিন্তু তখনো কিশোরী মাত্র। তারপর সামিনা এলেন, এন্ড্রু কিশোরের সাথে এই ডুয়েট গানটি করলেন। পরে সামিনা চৌধুরি আর এন্ড্রু কিশোরের ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

 


৫. তুমি যেখানে আমি সেখানে, সে কি জানো না

এই গানটা যে সময়কার, সে সময় এ ধরনের গান কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না। সিনেমায় তো ছিলই না। কোনো ব্যান্ডেরও এ ধরনের গান ছিল না। কারো ধারণাই ছিল না, এ রকম একটা গান হতে পারে। এটা ১৯৮৩ সালে ‘নাগ পূর্ণিমা’ সিনেমার গান। গীতিকার ছিলেন মনিরুজ্জামান মুনির। ওই ছবির নায়ক ছিলেন সোহেল রানা। তিনি বেশ স্মার্ট লোক। উনি আলম খানকে বললেন, ‘একটু ইংরেজি গানের মতো করে গান করেন।’ আলম খান বললেন, ‘ইংরেজি করব মানে, আপনার সিনেমা তো বাংলা? একদম ইংরেজি গান তো আর হবে না, তবে ইংরেজির আদলে একটা বাংলা গান হবে বলতে পারি।’

তার পরে অনেক গবেষণা করে আলম খান এই চমৎকার এবং ব্যতিক্রম গানটি সুর করলেন। গানটিতে তালের একটা ব্যাপার আছে, বেশ কঠিন। ২৪ মাত্রার মতো করে কন্টিনিউয়াস একটা মিউজিক  বাজতে থাকে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাওয়া এন্ড্রু কিশোরের জন্যও বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। গানের ট্র্যাক তৈরি হলো, কিন্তু এন্ড্রু কিশোর ভরসা পাচ্ছেন না যে এই গান কীভাবে গাইবেন! গানটি তুললেন তিনি। তারপর আলম খানকে বললেন, স্কেলটা একটু নামিয়ে দেন। তখন আলম খান বললেন, ‘পারভেজ (সোহেল রানা) আসুক, তারপর স্কেল নামায় দিবো নে।’ পরে সোহেল রানা এলেন। উনি শুনে বললেন, ‘কি মিয়া, তুমি বাংলাদেশের স্টার আর তুমি বলছ পারবা না? দেখো চেষ্টা করে, তুমি পারবা।’ এন্ড্রু কিশোর বললেন, ‘পারছি না তো ভাই, এত উপরের স্কেলে গাইলে তো আমি মারা যাবো।’ সোহেল রানা বললেন, ‘তুমি আমার গায়ক। তোমার গলায় সব গান আমাকে মানায়। তুমি মরে যাও না পড়ে যাও বুঝি না, তোমাকে ঠিক এই স্কেলেই গাইতে হবে।’ রেকর্ডিং যিনি করছিলেন, তিনিও এন্ড্রু কিশোরের কষ্ট দেখে সোহেল রানাকে বললেন, ‘ওর এই স্কেলে গাইতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’ তারপরও সোহেল রানা না মেনে বললেন, ‘কষ্ট করেই গাও। কষ্ট করলেই কেষ্ট মিলবে। বেঁচে থাকবে এই গান।’ কী আর করা, এই হাইস্কেলের গানটি গাইতেই হলো এন্ড্রু কিশোরকে।  

 


৬. আজও বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গার ধারা

এন্ড্রু কিশোরই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি আর ডি বর্মনের সুরে হিন্দি গান গেয়েছেন। বাংলাও গেয়েছেন। মোট তিনটি গান তিনি গেয়েছিলেন। তার মধ্যে দুটি হিন্দিতে এবং বাংলা ছবির জন্য একটি বাংলায়। ‘ইসকি টুপি উসকি সার’ নামের গানটা হিন্দিতে গেয়েছিলেন কিশোর কুমার, যার বাংলা ভার্সনটা এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন। বিখ্যাত গীতিকার মাজরু সুলতানপুরির লেখা ‘সুরেজ চান্দা’, ‘মে তেরি বিসমিল হু’ এই হিন্দি গান দুটি গাওয়ার পাশাপাশি বাংলা ‘মুখে বলো তুমি হ্যাঁ, ‘এর টুপি ওর মাথায়’ এবং ‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা’ গানগুলো আর ডি বর্মনের সুরে গেয়েছিলেন। তখন ১৯৮৫ সাল। যৌথ প্রযোজনার ছবি। ভারতের হয়ে প্রযোজক ও পরিচালক ছিলেন প্রমোদ চক্রবর্তী। ভারতে এই ফিল্মের নাম ছিল ‘শত্রু’ আর বাংলাদেশে ‘বিরোধ’। অভিনয়ে রাজেশ খান্না ও শাবানা। এ সিনেমায় গান গাইতে গিয়ে খুবই জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তিনি তখন দেশের বাইরে। এসে শুনলেন, ‘শাওন সাগর প্রোডাকশনের’ একজন প্রযোজক এন্ড্রু কিশোরকে খুঁজছেন। উনার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরের দিন ভারতীয় দূতাবাসে গেলেন কিশোর। সেখানে এক বড় কর্মকর্তাকে কিশোরের পরিচয় দিয়ে খুব গর্ব করে ওই প্রযোজক বলেলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত গায়ক। আপনাদের আরডি বর্মনের সুরে গান গাইতে আপনাদের দেশে যাবে। কাল-পরশুর মধ্যে ভিসার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। মুম্বাইতে স্টুডিও রেকর্ডিং আছে।’ ওই কর্মকর্তা অনেকক্ষণ শুনে মুচকি হেসে বললেন, ‘যাবেন তো ঠিক আছে, কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট কই? ওটা ছাড়া তো গান গাইতে পারবেন না।’   

যা হোক, তারপরও মুম্বাই গেলেন এন্ড্রু কিশোর। কাউকেই চেনেন না। কিন্তু সেখানে যাবার পর পরিচালক প্রমোদ চক্রবর্তী খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আপন করে নিলেন। তার আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। আলাপের একপর্যায়ে ‘ওয়ার্ক পারমিটের’ বিষয়টি উঠলে উনি বললেন, ‘বলিস কী! আমি তো ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। তুই এখানেই থাক, ঘুরে ঘুরে মুম্বাই শহরটা দেখ। বিকেলে পঞ্চমের ওখানে তোকে নিয়ে যাব। আমি দিল্লিতে গিয়ে তোর ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করি।’ পরে সন্ধ্যাবেলা আর ডি বর্মনের মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাসায় গেলেন এন্ড্রু কিশোর। আর ডি বর্মন কখনই এন্ড্রু কিশোরকে নাম ধরে ডাকেননি। আদর করে ‘ঢাকাইয়া’ বলেই ডাকতেন। সৌজন্য আলাপের পর আর ডি বর্মন বললেন, ‘শোন ঢাকাইয়া, তুই প্রতিদিন বিকেলে আমার এখানে চলে আসবি।’ এর পরেই কেয়ারটেকারকে ডেকে বললেন, ‘এই ঢাকাইয়া এলে এই সিটিংরুম খুলে বসতে দিও।’ বলে রাখা উচিৎ, সংগীত পরিচালকদের  সিটিংরুমে সবাই প্রবেশ করতে পারে না। কারণ, সিটিংরুম খুবই সিক্রেট জায়গা। সেখানে সুর সৃষ্টি হয়। এতে সুর লিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু উনি প্রথম থেকেই এন্ড্রু কিশোরকে খুব স্নেহ করলেন এবং সিটিংরুমে বসার অনুমতি দিয়ে দিলেন। পরে এন্ড্রু কিশোরকে গানগুলো শেখার জন্য উনি নিজে গেয়ে একটি ক্যাসেটে করে দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে। এন্ড্রু কিশোরের কাছ থেকে শোনার  নাম করে লোকে নিয়ে গেছে, আর ফেরত দেয়নি সেটি। সেখানে আর ডি বর্মনের নিজের গলায় গাওয়া তিনটা গান ছিল। সেটার আর্কাইভ ভ্যালু এখন হতো অন্যরকম। শুধু তাই নয়, তিনটা গান কতভাবে গাওয়া যায়, চারবার-পাঁচবার করে গেয়ে গেয়ে দেখানো ছিল ক্যাসেটিটিতে।   

ক্যাসেটে উনি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, ‘ঢাকাইয়া তুই এইভাবে গাইতে পারিস, তুই এভাবেও গাইতে পারিস, আচ্ছা এ রকম গেয়ে দেখ তো।’ সেই সময় আর ডি বর্মনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন এন্ড্রু কিশোর। এত কাছের হয়ে গেলেন যে, আশা ভোঁসলের সঙ্গে কীভাবে প্রেম হলো, সেসব গল্পও করতেন তার সঙ্গে। তারপর দেশে চলে এলেন। পরে ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার প্রায় এক-দেড় মাস পর আবার মুম্বাই গেলেন এবং স্টুডিওতে ভয়েস দেওয়া শুরু করলেন।    

 

 

৭. সুরাজ চান্দা সাগর পার্বত সাব হে পেহেলে জেসে

‘আজো বয়ে চলে পদ্মা মেঘনা বুড়িগঙ্গার ধারা’ গানটির হিন্দি ভার্সন ‘সুরাজ চান্দা’ গানটি এন্ড্রু কিশোর গাচ্ছেন, ওমা! দেখেন যে , প্রমোদ চক্রবর্তী ও আর ডি বর্মনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলো! প্রমোদ চক্রবর্তী বললেন, ‘পঞ্চম গান ঠিক আছে, কিন্তু আমার কোথায় যেন ভুল মনে হচ্ছে।’ আর ডি বর্মন বললেন, ‘তুমি বলো, কী ঠিক হচ্ছে না? আমি মিউজিক ডিরেক্টর, কিন্তু আমি তো কোনো ফাঁক পাচ্ছি  না।’ তারপর দুজনের ঝগড়ার শেষে সমাধান করতে আশা ভোঁসলেকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আশা ভোঁসলের কথা শুনেই এন্ড্রু কিশোরের হাত-পা এবং গলা কাঁপা শুরু হয়ে গেল। আর ডি বর্মন তা দেখে  বললেন, ‘কী রে, তোর নার্ভাস লাগছে নাকি ঢাকাইয়া?’ এন্ড্রু কিশোরে বললেন, ‘আশাজিকে  ডেকেছেন?’ আর ডি বর্মন বললেন, ‘আমি তো ডাকতে চাইনি। তোর চাটুজ্জে নিয়ে আসছে।’ ঘণ্টা  কয়েক পরে আশা ভোঁসলে এলেন। তখন আশা ভোঁসলেকে এন্ড্রু কিশোরের গান শুনে উচ্চারণে কোথায় ফাঁক আছে, সেটা ধরে দিতে এবং ঠিক করে দিতে বলা হলো। তখন আশা ভোঁসলে খালি গলায় গানের স্থায়ীটি গাইতে বললেন। এবং কিশোরকে বললেন, ‘পঞ্চম আমাকে তোমার কথা অনেক বলেছে যে, তুমি ঢাকায় ফিল্মে অনেক গান করো। নিশ্চয়ই তুমি কিছু সাইন ব্যবহার করো? আমি গেয়ে দেখাচ্ছি, তুমি যদি তোমার সাইনগুলো ব্যবহার করো, তাহলে আমার সঙ্গে গানের ফারাকগুলো কী হচ্ছে তুমি বুঝে নিতে পারবে এবং তোমার সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।’

তারপর উনি খালি গলায় গাইলেন আর এন্ড্রু কিশোর সাইন ব্যবহার করে ঠিক করে নিলেন। আশা ভোঁসলে বললেন, ‘এবার তুমি ভয়েস দাও। আমি শুনি।’ কিন্তু এন্ড্রু কিশোর তো আর গাইতে পারছেন না। তিনি বললেন, ‘না, আপনি সামনে থাকলে আমি প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি, গান গাইতে পারছি না।’  এটা শুনে আর ডি বর্মন একদম খেপে গেলেন, ‘ব্যাটা আমি আশা ভোঁসলেকে বানালাম, তুমি আমার সামনে রাতদিন গান গাইতে পারো, আর ভোঁসলের সামনে গাইতে পারছ না?’ ব্যাপারটা তাঁর খুবই ইগোতে লেগেছিলো। প্রমোদ চক্রবর্তী আর ভোঁসলেকে অনুরোধ করাতে উনি চলে যান। পরে এন্ড্রু কিশোর এই গান করেন।   

 


তথ্য সূত্র: এন্ড্রু কিশোরের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাতকার থেকে সংকলিত।