দেখতে কেমন মায়ের রূপ

By: হুমায়ূন শফিক ২০২০-০৫-১০ ৩:৪৪:০৪ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-২৫ ১:৪৪:১৭ এএম শিল্প
মায়ের পৃথিবী যেনো সন্তানকে ঘিরেই

মাকে নিয়ে বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা হয়েছে। সেসব পড়ে হয়তো কেঁদেছি বা ভালোবেসেছি শুধু মাকে। আবার এমন কিছু গল্প, উপন্যাস বা রূপকথা আছে যেখানে মায়ের চরিত্রকে আমরা ঘৃণাও করেছি! তারপরও বলব মা তো মা-ই। মায়ের তুলনা হয় না।

 

‘‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’-তে রবীন্দ্রনাথ মাতৃস্মৃতি উদ্ধৃতি করতে গিয়ে কথাটি বলেছিলেন।

রবীন্দ্রসাহিত্যে সারদা সুন্দরী দেবী আসেন নি ঠিকই, তাই বলে কি তিনি মাকে ভালোবাসতেন না? অবশ্যই বাসতেন। মাতৃস্মৃতি তাঁর ভেতরে মাঝে মাঝেই জেগে উঠত। পরিণত মধ্য বয়সেও রবীন্দ্রনাথের মনে মাতৃস্মৃতি পুনরায় ফিরে এসেছিল তারই প্রমাণ মেলে ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে প্রদত্ত এক উপদেশে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দেখা এক স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন: ‘‘… আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি। আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন। আমার বড়ো বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগান বাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন। তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার কী হল জানি নে। আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন। তখনই তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’  এইখানে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।’’

বাংলা সাহিত্যে মাকে নিয়ে বেশ কিছু উপন্যাস লেখা হয়েছে। যেমন ধরা যাক মানিকের ‘জননী’। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের যে কয়েকটি লেখা কালজয়ী বলে সমালোচকগণ দাবি করেন, সেগুলোর মধ্যে তাঁর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ (২ মার্চ, ১৯৩৫) অন্যতম। অনেকের মতে এটি মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। শ্যামা নামে এক নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের বহুবিধ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। ‘জননী’ নামে আরেকটা উপন্যাস আছে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের। এই উপন্যাসটির প্রশংসা বেরিয়েছিল ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান-এ। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি বাংলাসাহিত্য নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদের প্রায় প্রত্যেকে পড়েছেন। চাষী নজরুল ইসলাম ১৯৯৭ সালে এই উপন্যাসটি সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেন।

উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। কালীগঞ্জ গ্রামের এক সাহসী মায়ের গল্প। যে মা মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে প্রতিবন্ধী ছেলেকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেন নি। এছাড়াও আছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ ইত্যাদি।

বিশ্বসাহিত্যেও মাকে নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত লেখা হয়েছে। যেমন: গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস, ইতালিয় লেখক গ্রেজিয়া দেলেদ্দার ‘লা মাদ্রে’, আমেরিকান-চিলিয়ান লেখক ইজাবেল অ্যালেন্দের ‘পল’, বিট্রিশ লেখক কেট অ্যাটকিনসনের ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস অ্যাট দ্য মিউজিয়াম’, কানাডার মার্গারেট এটউডের ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’ ইত্যাদি।

সাহিত্যে মায়ের চরিত্রগুলো কিছুটা সেনসিটিভ। কারণ মাকে আমরা সবাই ভালোবাসি। তারপরও এমনকিছু মা চরিত্র আছেন যারা সবচেয়ে বেশি ঘৃণার পাত্র হয়েছেন পাঠকের কাছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১-এ ইউরিপিডিসের লেখা ট্র্যাজেডি নাটক ‘মিডিয়া’তে দেখা যায় মিডিয়া তার নিজের সন্তানদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে করে তার কাজ হাসিল করে। গ্রিক মিথলজির আরেকজন মা হচ্ছেন হেরা। তার ধারণা সব শিশুর মধ্যে শয়তান বিরাজ করে। শিশুদের তিনি দুই চোখে দেখতে পারতেন না। হেফাসটাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিক মিথলজিতে ভলকানোর দেবতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখতে খুবই বাজে ছিলেন। শুধু এই কারণে তার নিজের মা হেরা তাকে অলিম্পাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেন।

রাজা ইডিপাসের ঘটনা অনেকেই জানেন। ছেলে বাবাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করে। ফ্রয়েডের তো এমন একটি সূত্র আছে। তবে ফ্রয়েডের সূত্রটা যদিও ঈর্ষার, তবে এই কাহিনীর সাথে মেলানো যায়ই। ‘রাজা ইডিপাস’ নাটকের মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে থিবসের রাজা লেয়াস ও তার স্ত্রী জোকাস্টাকে ঘিরে। বহুদিন সন্তান না হওয়ার কারণ জানতে রাজা লেয়াস একাকী ডেলফির মন্দিরে যান। দৈববাণী শোনা গেল যে, তার এই সন্তান না হওয়ার দুর্ভাগ্যকে তার আশীর্বাদ মনে করা উচিত। কেননা জোকাস্টার গর্ভজাত এবং তার ঔরসজাত সন্তান কালে তার হত্যাকারী হবে। সে জোকাস্টাকে কোনো কথা জানাল না, বরং সে জোকাস্টা থেকে দূরে দূরে থাকতে লাগল। জোকাস্টা তাকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে সন্তানবতী হলো। নয় মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র লেয়াস ধাত্রীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক মেষপালকের হাতে দিলো তাকে মারার জন্য। নবজাতকের পা দুটো লোহার শিক দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো যাতে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পারে। কিন্তু বিধির বিধান অলঙ্ঘনীয়। নিয়তির নির্দেশে নবজাতকের মৃত্যু হলো না। পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক তাকে কুড়িয়ে পেলো এবং তার নাম দিলো ইডিপাস। কেননা তার পা দুটো পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করায় ফুলে গিয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ইডিপাস শব্দের অর্থ ‘পা ফোলা’। মেষপালক তাকে করিনথে নিয়ে এলো। সে সময় রাজা পলিবাস করিনথে শাসন করছিলেন। রাজা পরিবাস ও রানী মেরোপী নিঃসন্তান। তাই তারা ইডিপাসকে আপন সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করতে লাগলো। এই সন্তানই পরে যুদ্ধ করে লেয়াসকে হত্যা করে এবং জোকাস্টা মানে তার মাকে বিয়ে করে।

সৎ মাকে ঘৃণার করার একটা প্রবণতা সব জায়গায়ই দেখা যায়। সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম খুব কম হয়েছে। সিনডেরেলা, হ্যানসেল এবং গ্রেটেল এবং স্নোহোয়াইট গল্পগুলোতে ভিলেন হিসেবে সৎ মাকেই দেখা যায়। এই মায়েদের লাখ লাখ মানুষ এখনো ঘৃণার চোখেই দেখে।

বিশ্ব-সাহিত্যে এমন কিছু চরিত্র আছে যারা জন্মের অল্প পরে বাবা-মাকে হারায় এবং বাকি জীবনজুড়ে একা বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিজেদের স্ট্রাগল চালিয়ে যায়। সেই চরিত্রগুলোকে সবাই ভালোবাসে। তাদের দুঃখে কাঁদে। সুখে হাসে। যেমন: ভিক্টর হুগোর ‘দ্য হ্যাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম’ বইয়ে কুঁজো প্রহরী চরিত্রটি জানতোই না তার মা কে ছিলেন। মায়ের ভালোবাসা সে পায় নি। একাকী জীবন। সে জীবনে আসে ভালোবাসা। জিপসি সুন্দরীর প্রতি। কিন্তু সে ভালোবাসা নিয়ে যে গল্প ফেঁদেছেন লেখক তা খুবই হৃদয়স্পর্শী। জে.কে রাউলিং-এর বিখ্যাত চরিত্র হ্যারি-পটার। এমনও শোনা যায় যে, জে.কে রাউলিংকে অনেকেই চেনেন না বা নাম পর্যন্ত শোনেন নি, কিন্তু হ্যারিপটারকে ঠিকই চেনেন। হয়তো এমনটি ঘটেছে পটারকে নিয়ে সিনেমা বানানো হয়েছে সে কারণে।

থাক সেসব কথা, হ্যারি পটার জন্মের কিছুদিন পরেই তার বাবা-মাকে লর্ড ভোল্ডামর্ট হত্যা করে। পটার বড় হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সবকিছু জানতে পারে। ছোটবেলায় সে একটুও মায়ের আদর পায় নি। সে মাকে অনেক মিস করে। মিস করে বাবাকেও। তাই তো বারবার বাবা-মা দুইজনের কথাই তার মনে পড়ে।

এবার একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিয়ে শেষ করি। সাহিত্যে এমনকিছু চরিত্র আছে, যাদের কোনো পিতা-মাতা নেই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এ্যাথেনা, পান্ডোরা, গালাটি, পিনোকিও এবং ফ্রাঙ্কেইনস্টাইনের সৃষ্টি সেই দানব ইত্যাদি। এদের কেউ না কেউ বানিয়েছে বা বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও চরিত্রগুলো মানুষ ভালোবেসেছে। অনেক চরিত্র ঘৃণাও কুড়িয়েছে।