বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধের সুলুকসন্ধান

By: অতনু চক্রবর্ত্তী ২০২০-০৬-১৩ ১১:৩৭:১৫ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-১৯ ৪:৫৫:০৭ পিএম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
অনলাইন থেকে সংগৃহীত ছবি

“তখনও এই রকম কালবৈশাখী নামবে, এই রকম মেঘান্ধকার আকাশ নিয়ে, ভিজে মাটির গন্ধ নিয়ে, ঝড় নিয়ে, বৃষ্টির শীকরসিক্ত ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া নিয়ে, তীক্ষ্ম বিদ্যুৎ চমক নিয়ে-তিন হাজার বছর পরের বৈশাখ-অপরাহ্নের উপর । তখন কি কেউ ভাববে তিন হাজার বৎসর পূর্বের প্রাচীন যুগের এক বিস্মৃতি কালবৈশাখীর সন্ধ্যায় এক বিস্মৃত গ্ৰাম্য বালকের ক্ষুদ্র জগৎটি এই রকম বৃষ্টির গন্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায় কি অপূৰ্ব আনন্দে দুলে উঠতো ? এই মেঘান্ধকার আকাশের বিদ্যুৎ চমক-সকলের চেয়ে এই বৃষ্টির ভিজে সোঁদা সোঁদা গন্ধটা কি আশা উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা দূর দেশের, দূরের উত্তাল মহাসমুদ্রের, ঘটনাবহুল অস্থির জীবনযাত্রার কি মায়া-ছবি তার শৈশব-মনে ফুটিয়ে তুলতো ?” 
 
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “অপ্রকাশিত দিনলিপি” থেকে নেওয়া কথাগুলো পড়তে পড়তে গ্রামের সদ্য বৃষ্টিতে ভেজা মাটির অন্যরকম গন্ধটা বুক ভরে নিতে ইচ্ছে করছে না ? হ্যাঁ! প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রায় সবাই বৃষ্টির এই দারুণ গন্ধকে ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু কখনও ভেবেছো কি এই ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের উৎস কোথায় আর কিভাবেই বা এই গন্ধের সৃষ্টি হয় ? আচ্ছা চলো এখন এই গন্ধের সুলুকসন্ধানে নেমে পড়া যাক।

বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধের খুব সুন্দর একটি ইংরেজি শব্দ রয়েছে। ইংরেজিতে এই গন্ধটিকে ডাকা হয় পেট্রিকোর (Petrichor) নামে। বৃষ্টির ফোঁটা যখন শুকনো মাটিতে পড়ে তখন এই পেট্রিকোরের সৃষ্টি হয়। পেট্রিকোর কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। যার আভিধানিক অর্থ পাথরের শোণিতধারা (The blood of stones).  অস্ট্রেলিয়ান কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (CSIRO) এর দুইজন বিজ্ঞানী ইসাবেল জয় বিয়ার এবং রিচার্ড থমাস এই শব্দটি প্রথম প্রস্তাব করেন। ১৯৬৪ সালে নেচারে প্রকাশিত তাদের গবেষণা প্রবন্ধে তারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। সাধারণত বৃষ্টির আগে শুকনো মাটি বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে এক ধরণের তেল পরিশোষণ করে থাকে। এই দুইজন গবেষক সেই পরিশোষিত তেলকে আবার সংশ্লেষ করতে সক্ষম হন। তারা দেখান যে যখন বৃষ্টি হয় তখন এই পরিশোষিত তেল জিওস্মিন নামে আরেক ধরণের যৌগের সাথে মিশ্রিত হয়ে বায়ুতে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এই দুই যৌগের বায়ুতে মেশার ফলেই বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সৃষ্টি হয়।

শুকনো মাটি উদ্ভিদ থেকে যে তেল পরিশোষণ করে থাকে সেই তেলের মূলত মিশে থাকে পামিটিক এসিড, স্টিয়ারিক এসিড এবং আরও নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থ যার সবগুলিকে বিজ্ঞানীরা এখনো নির্দিষ্ট করতে পারেননি। তবে মাটিতে মিশে থাকা পামিটিক এসিড ও স্টিয়ারিক এসিডের এই বৃহৎ অণু বৃষ্টির সময় বিশ্লিষ্ট হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র অণু যেমন কিটোন, এলডিহাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হয়।  অন্য দিকে জিওস্মিন পদার্থটি মাটিতে বাস করতে থাকা এক্টিনোব্যাক্টেরিয়া পর্বভুক্ত অণুজীবদের দ্বারা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরণের সায়ানোব্যাক্টেরিয়া এবং স্ট্রেপ্টোমাইসিস গণের ব্যাকটেরিয়ার মৃত কোষ থেকে মূলত জিওস্মিন সৃষ্টি হয়। ২০০৬ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম স্ট্রেপটোমাইসিস কোয়েলিকালার (Streptomyces coelicolor) ব্যাকটেরিয়ায় থাকা উৎসেচক থেকে জিওস্মিনের জৈব সংশ্লেষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন। 

জিওস্মিন উৎপাদী বিক্রিয়া
ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের পেছনের জীববৈজ্ঞানিক কারণ তো জানা গেল। কিন্তু এরপর বিজ্ঞানীরা চিন্তা করতে লাগলেন এই গন্ধ আমাদের নাকে এসে পৌঁছায় কি করে। অর্থাৎ এর পেছনে থাকা পদার্থবিজ্ঞানের ব্যখ্যাটা ঠিক কিরূপ ? 

এই গন্ধের উৎস এবং প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানতে ২০১৫ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) এর একদল গবেষক ১৮ ধরণের মাটির সংস্পর্শে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে দিয়ে প্রায় ৬০০ টি পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। খালি চোখে না দেখা গেলেও আমরা সকলেই জানি যেকোন মাটির সমতল থাকে অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত। বৃষ্টির ফোঁটা যখন এই মাটির তলে এসে পড়ে তখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্রে আটকে থাকা বাতাস থেকে বুদ্বুদের সৃষ্টি হয়। এই বুদবুদ যখন মাটির সমতল থেকে বায়ুর সংস্পর্শে এসে ফেটে যায় তখন এই বুদ্বুদে আটকে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাসায়নিক অণু বাতাসে মিশে এই সোঁদা গন্ধের জন্ম দেয়।

শুধু জিওস্মিন কিংবা উদ্ভিজ তেলকণা নয়, মাটিতে থাকা অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা অন্যান্য রাসায়নিক অণুও এই বুদ্বুদে মিশে থাকতে পারে। যত ধীরে বৃষ্টিকণা মাটিতে পড়ে তত বেশি বুদ্বুদ বাতাসে মিশে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর তাই খুব হালকা এক পশলা বৃষ্টির পরে ভেজা মাটির গন্ধ অপেক্ষাকৃত তীব্রতর বলে মনে হয়। 

আমাদের নাসারন্ধ্রে থাকা ঘ্রাণ সংবেদকগুলি জিওস্মিনের গন্ধের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তাই বাতাসে এর পরিমাণ প্রতি ট্রিলিয়নে ৫ ভাগ, অর্থাৎ প্রতি কেজি বাতাসে মাত্র ৫ ন্যানোগ্রাম (৫ × ১০-৯ গ্রাম) থাকলেই মানুষের নাক তা শনাক্ত করতে পারে।এই সোঁদা গন্ধকে কাজে লাগিয়ে নানা সুগন্ধি তৈরি করার সম্ভাবনা নিয়েও তাই মানুষ অনেক সময় চিন্তা করেছে। স্বাধীনতার বেশকিছু আগে ভারতীয় উপমহাদেশের নানা স্থানে দেশীয় সুগন্ধি দ্রব্য তৈরির শিল্প গড়ে উঠেছিল। শ্রমিকেরা গরমকালে মাটি শুকিয়ে তারপর বর্ষার আগে বাষ্প-পাতন (steam distillation) করে সেই বাষ্প চন্দনের তেলে মিশিয়ে নিত আর তারপর সেই তেল বিক্রি করত বাজারে । উত্তর প্রদেশে এর জনপ্রিয় নাম ছিল “মিট্টি আতর” । এই মিট্টি আতর এখনও বেশ জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বিক্রি হয়। 

শুধু মাটির সোঁদা গন্ধ নয়, জলের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কিংবা মাটির নিচে হওয়া সবজিগুলির মেটে স্বাদও এই জিওস্মিনের জন্যেই হয়ে থাকে। জিওস্মিনের এমন নানা ধরণের উপকারী দিকের পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন মাটির বিভিন্ন স্তরের ব্যাকটেরিয়ার মৃতকোষ থেকে যেহেতু এই গন্ধের সৃষ্টি হয় সেহেতু অনেক সময় কোন স্থানে নলকূপ খননের পর সে স্থানের পানীয় জলে এই ঘ্রাণ মিশে থাকে। এতে ওই স্থানের পানি সুপেয় হয় না। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এই ঘ্রাণকে কিভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়েও বিস্তারিত গবেষণা করছেন।

সোঁদা মাটির গন্ধের পেছনের বিজ্ঞান সম্বন্ধে জানলে তো ? এরপর থেকে যখন বৃষ্টি দেখে রোমান্টিকতায় আক্রান্ত হবেন আর ভেজা গন্ধে দারুণ নস্টালজিয়া অনুভব করবে অবশ্যই সেই কাব্যময়তার মধ্যেও বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের কথা স্মরণে রাখতে একদম ভুলবে না কিন্তু ! 


- অতনু চক্রবর্ত্তী
বুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিন কোরিয়া।