হোজ্জার হাসির গল্প

By: সুখবর ডেস্ক ২০২০-০৬-১৮ ৮:২১:০৯ পিএম আপডেট: ২০২৪-১২-৩০ ১২:২২:৫৫ পিএম রঙ্গব্যঙ্গ
শিল্পীর কল্পনায় মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা

বিশ্বব্যাপী হাস্যরসাত্মক লোকসাহিত্যে হোজ্জা সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। হোজ্জার গল্পগুলোতে তাঁকে কখনো খুব চালাক, জ্ঞানী, শিক্ষিত বা দার্শনিক মনে হয়, আবার কখনো তাঁকে মনে হয় একেবারে বোকার হদ্দ। তবে শেষ বিচারে প্রতিটি গল্পেই থাকে হাসির খোরাক।

হোজ্জার গল্পগুলোকে একেবারে সাদামাটা হাসির গল্পও বলা যাবে না। সাধারণ হাসির গল্পের চেয়ে এর স্বাদ আরেকটু বেশি। গল্পগুলো হাসির, কিন্তু কখনো কখনো তা পাঠকের চিন্তাকে নাড়া দেয়।

গল্পগুলোতে হোজ্জাকে সব সময় স্পষ্টবাদী হিসেবে দেখা যায়। তিনি কখনো বাদশাহ বা জমিদারকে বোকা বানাচ্ছেন, আবার সাধারণ মানুষকেও ছাড় দিচ্ছেন না। গল্পে তাঁকে সব সময়ই পাওয়া যায় দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের পাশে; অত্যাচারী বাদশাহ, জমিদার, লোভী ও কৃপণ বড়লোকদের বিরুদ্ধে।

গল্পগুলোর অন্যান্য চরিত্রেও আছে বৈচিত্র্য। ফকির থেকে বাদশাহ, শিশু থেকে বৃদ্ধ, কৃষক, সৈনিক- সব শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ গল্পগুলোকে প্রাণময় করে তুলেছে।

 


‘হুমম, তোমার কথাই ঠিক’

নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। বাদি মামলার আসামির সম্পর্কে যেসব অভিযোগ করছেন হোজ্জা তা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, হুমম, তোমার কথাই ঠিক।

এ কথা শুনে আসামি বলে উঠল, হুজুর, আমার কিছু কথা ছিল। হোজ্জা বললেন, ঠিক আছে, বলো তুমি কী বলতে চাও? আসামির বক্তব্যও মনোযোগ দিয়ে শোনার পর হোজ্জা বললেন, হুমম, তোমার কথাও ঠিক।

হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, দুইজনের কথাই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক না হয় বাদির কথা ঠিক।

হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে হাসি দিয়ে বললেন, হুমম, তোমার কথাই ঠিক।


‘আমি বাজিতে জিতে গেছি’

একবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জা অসুস্থ হওয়া স্ত্রীকে বলল গাধাটাকে খাবার দিতে। স্ত্রী গাধাকে খাবার দিতে অস্বীকার করল। দুজনের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল ঝগড়া শুরু হল। ঝগড়া শেষে তারা সিদ্ধান্ত নিল, দুজনের মধ্যে যে আগে কথা বলবে সে-ই গাধাকে খাবার খাওয়াবে। বাজিতে জেতার আশায় তারা কেউ কারো সাথে কথা বলল না। ওই দিনই বিকেলে হোজ্জার স্ত্রী বাইরে গেল। এ সময় ঘরে একটা চোর ঢুকল। হোজ্জা ঘরেই ছিল কিন্তু বাজিতে হেরে যাওয়ার ভয়ে সে চোরকে কিছু বলল না। চোর নির্বিঘ্নে ঘরের সব কিছু নিয়ে চলে গেল। হোজ্জার স্ত্রী বাসায় ফিরে এসে যখন দেখল সব কিছু খালি তখন চিৎকার দিয়ে বলল, ‘হায় আল্লাহ! একি হল! ঘরে চোর এসেছিল নাকি?’

হোজ্জা স্ত্রীর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠল, আমি বাজিতে জিতে গেছি, এখন গাধাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তোমাকেই পালন করতে হবে। হা হা হা।

 


‘প্রস্তুত প্রণালী তো আমার কাছে’

একদিন হোজ্জা বাজার থেকে গরুর কলিজা কিনে বাসায় যাচ্ছিল। দোকানদার একটা কাগজে তাকে কলিজাভূনা করার পদ্ধতি লিখে দিয়েছিল, যাতে বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারেন। হঠাৎ একটি বাজপাখি উড়ে এসে কলিজার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে উড়ে চলে গেল।

এসময় হোজ্জা চেঁচিয়ে  বলল, ‘আরে বোকা!’ কলিজা নিয়ে গেলে কী হবে? প্রস্তুত প্রণালী তো আমার কাছে!’

 


‘কে মারা গেছে-তুমি না, তোমার ভাই?’

হোজ্জার গ্রামে যমজ ভাই ছিল। একদিন শোনা গেল, ওই যমজ ভাইদের একজন মারা গেছে। রাস্তায় ওই যমজ তাদের একজনকে দেখে হোজ্জা দৌড়ে গেলেন তার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে মারা গেছে-তুমি না, তোমার ভাই?’

 

 

বেড়ালটা গেল কোথায়?’

মোল্লা নাসিরউদ্দিন একবার বাজার থেকে খাসির গোশত কিনে আনলেন। স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন “অনেকদিন গোশত খাইনি। ভালো করে রাঁধো যেন খেয়ে মজা পাই।”

মোল্লা’র স্ত্রীও অনেকদিন গোশত খায়নি। তাই রান্নার পর একটু একটু করে খেতে খেতে সবটা গোশতই খেয়ে ফেলল। মোল্লা খেতে বসলে তাঁর স্ত্রী মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, “আজ আর তোমার বরাতে গোশত নাই, সব গোশত বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে।”

নাসিরউদ্দিন অবাক হয়ে বলল: পুরো এক সের গোশতই বিড়াল খেয়ে ফেলল?’

জি বলল: তাহলে আমি বলছি কি!

স্ত্রীর কথা মোটেই বিশ্বাস করল না মোল্লা। তখনই বিড়ালটাকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখল ওর ওজন ঠিক এক সের। মোল্লা বলল, ‘এটাই যদি সেই বেড়াল হয়, তাহলে গোশত কোথায়?  আর এটা যদি গোশতের ওজন হয় তাহলে বেড়ালটা গেল কোথায়?’

 

 

‘আলখাল্লা’র পরিবর্তে জোব্বা’

একদা মোল্লা নাসিরউদ্দিন নিজের জন্য একটা জোব্বা কিনতে গেল একটি দোকানে। তো পছন্দ করার পর দোকানদার জোব্বাটা প্যাকেট করে দিল। মোল্লা জোব্বা নিয়ে চলে আসার সময় ভাবলেন জোব্বা না নিয়ে বরং একটি আলখাল্লা নিয়ে যাই। দোকানীকে বলল, আপনি বরং আমাকে একটি আলখাল্লা দাও। দোকানী আলখাল্লা দেয়ার পর মোল্লা নাসিরউদ্দিন তা নিয়ে বের হয়ে আসার সময় দোকানী ডেকে বলল, হোজ্জা সাহেব আপনিতো আলখাল্লা’র মূল্য পরিশোধ করেননি। তখন মোল্লা উত্তর দিল আমি তো আলখাল্লা’র পরিবর্তে জোব্বা’টা রেখে গেলাম। তখন দোকানী বললেন, আপনিতো জোব্বা’র জন্যও মূল্য পরিশোধ করেননি। প্রতি উত্তরে মোল্লা বললেন, যেটা আমি নেইনি তার জন্য মূল্য পরিশোধ করব কেন?

 

 

‘জামা-কাপড় দিয়ে কী হবে?

নাসিরুদ্দীন হোজ্জা খুব যত্ন করে একটা খাসি পুষত। নাদুস-নুদুস সেই খাসিটার ওপর পড়শিদের একবার বদনজর পড়ল। একদিন কয়েকজন মিলে হোজ্জার বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। হোজ্জাকে ডেকে বলল: “ও মোল্লা সাহেব, বড়ই দুঃসংবাদ। আগামীকাল নাকি এ দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। হায়! এত সাধের ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ, এমনকি আপনার ওই প্রিয় খাসিটাও থাকবে না!”

হোজ্জা বুঝলেন তাদের মতলবখানা কী? কিন্তু এতগুলো লোকের বদনজর থেকে খাসিটাকে রক্ষা করা সহজ ছিল না। তাই তিনি মুচকি হেসে পড়শিদের বললেন,তাই নাকি? তাহলে দুনিয়া ধ্বংসের আগে খাসিটা জবাই করে খেয়ে ফেলাই ঠিক কাজ হবে। তোমরা কী বলো?

মতলববাজ পড়শিরা তো এ সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। তাই তারা মোল্লার প্রস্তাবে খুশি হল এবং খাসিটা জবাই করে মহা ধুমধামে পেট পুরে খেল। তারপর গায়ের জামা খুলে হোজ্জারই বৈঠকখানায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখল তাদের জামা উধাও! সারা ঘর তন্নতন্ন করে জামা খুঁজতে লাগল তারা। হোজ্জা তখন বললেন, ভাইয়েরা! দুনিয়াই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে জামা-কাপড় দিয়ে কী হবে? তাই আমি সবার জামা আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছি!