হুমায়ূনের বিভ্রম 

By: হুমায়ূনের বিভ্রম ২০২০-০৭-১৯ ৮:১৯:৩৭ পিএম আপডেট: ২০২৪-১২-২১ ১০:২৩:৩১ পিএম মতামত
হুমায়ূন আহমেদ

তাঁর যে লেখালেখি সেটাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। একটা হলো বৃহত্তর ময়মনসিংহের পটভূমিতে গ্রাম বা মফস্বলের পরিবেশ। আরেকটা হলো ঢাকা শহর। এই সবগুলোই কিন্তু বাঙালির চেনা। এমন না যে তিনি সাইবেরিয়া নিয়ে লিখেছেন বা তিনি আলাস্কা নিয়ে লিখেছেন। তিনি যে জায়গা নিয়ে লিখেছেন বাঙ্গালি পাঠক সেই জায়গা গুলি চেনে।

 

বাঙালি পাঠকের চেনা জায়গা হচ্ছে নীলগঞ্জের একটা ট্রেন স্টেশন। বাঙালি পাঠকের চেনা জায়গা কাঠালবাগান মোড়। কিন্তু তিনি এই প্রতিদিনের চেনা জায়গাগুলোতে হিমু কিংবা মিসির আলিকে দিয়ে একটা বিভ্রম তৈরি করে ফেলেছেন। এই যে বিভ্রম তৈরি করার ক্ষমতা, এই ক্ষমতাটা খুব বিরল।

 

আজকাল লোকে কথায় কথায় ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা বলে। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ছোটগল্পে যে পরিমাণে ম্যাজিক করেছেন, মানে জাদুর ব্যবহার করেছেন, এটা আমার কাছে অতুলনীয় মনে হয়। বিশেষত বাংলা সাহিত্যে। ধরেন 'আয়না' নামে হুমায়ূন আহমেদের একটা ছোটগল্প আছে। আমরা যদি এই গল্পটা নিয়ে কথা বলি, এক ভদ্রলোক কোনোভাবে একটা আয়না হাতে পেয়েছেন। ঐ আয়নার ভেতরে একটা মেয়ে আছে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে, ভদ্রলোকের মেয়ের বয়সী। তাকেই মেয়েটা বাবা বলে ডাকে। এই মেয়েটার সঙ্গে তিনি প্রতিদিন কথা বলেন। হঠাৎ করে একদিন এই আয়নাটা হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় মানে কেউ একজন অপ্রয়োজনীয় আয়না ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। তারপর থেকে তিনি পাগলের মতো এই আয়নাটা খুঁজছেন। কেন? কারণ তিনি ভাবছেন এই মেয়েটার কী হবে? এই মেয়েটার তো কেউ নেই! মানে, তার যে নিজের জগৎ সেটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আয়নার মধ্যে বন্দি এই মেয়েটা। এই ভদ্রলোকের যেই চরিত্র সেটা কিন্তু খুব চেনা একটা চরিত্র। এই বিভ্রম তৈরি করতে পারার ক্ষমতাই হুমায়ূন আহমেদকে অনন্য করেছে বলে আমার মনে হয়।

 

তাঁর লেখার বর্ণনা হচ্ছে সাবলীল। সরল গদ্যে লিখেছেন সবসময়। মানে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যকে দুর্বোধ্য রাখতে চান নি। হুমায়ূন আহমেদের যে প্রবল পড়াশোনা দেশি-বিদেশি সাহিত্যে, প্রতাপ নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন তাতে তিনি চাইলে কঠিন ভাষাতেও লিখতে পারতেন। বরং কঠিন ভাষায় লেখাটাই স্বাভাবিক ছিলো। হুমায়ূন আহমেদের মতো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে একজন লেখক দাঁত বসানো যাবে না এমন ভাষায় লিখবেন, এটাই হয়তো লোকেরা আশা করেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ সেই জায়গায় নিজের একটা ভাষা তৈরি করেছেন।

 

ভাষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর হুমায়ূন আহমেদ এই তিনজনের লেখার যে বৈশিষ্ট্য তা হলো, সমকালীন অধিকাংশ পাঠক যেন খুব সহজে বুঝতে পারে, তেমন ভাষায় লেখালেখি করেছেন। এবং বিশেষণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, ক্রিয়াপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যান নি। যেই ভাষা মুখের, সেই ভাষাকেই তিনি প্রমিত একটা রূপে উপস্থাপন করেছেন। যেটা একটা কৃতিত্বের ব্যাপার। কেননা, সরল ভাষায় গরুর রচনা লেখাও কঠিন।

 

সরল ভাষায় লিখতে দিলে অনেক বড় সাহিত্যিকই গরুর রচনা লিখতে পারবেন না। জটিল করে ফেলবেন। আমি মনে করি তারাই জটিল করে লেখেন, যারা নিজেরাই পরিষ্কার থাকেন না ব্যাপারটা নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের ভাষার উপর দখল ছিলো বলেই খুব সরল ভাষায় লিখতে পেরেছেন এইভাবে।

 

 

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়