করোনার সাথে লড়ে যেভাবে জিতলেন দেবব্রত

By: দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ২০২০-০৫-১৫ ৪:৫৮:২৯ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-২৯ ৮:৫৫:৪০ পিএম সামাজিক যোগাযোগ
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। দেশে তার পরিচিতি ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। বর্তমানে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত। শিশুকিশোরদের জন্যে তার লেখা বেশ কিছু বইও রয়েছে। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন মে মাসের শুরুতে। সেসময় ঢাকাতে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। পনেরদিন তিনি ঢাকার একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের টেস্ট করানো হলে তার ফলাফল নেগেটিভ আসে।  
লড়াইটা শুরু হয় আসলে রিপোর্ট পাওয়া মাত্র। এর পর করোনাভাইরাস থেকে কিভাবে সেরে উঠলেন তার একটি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার আইডি থেকে।

এখন আমরা প্রায় সবাই করোনাভাইরাস আতঙ্কে আতঙ্কিত। এই দুর্যোগের মুহুর্তে দেবব্রত’র দেওয়া পরামর্শগুলো আমাদের আসার আলো দেখায়। তার দেওয়া পরামর্শগুলোও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিবেচনায় সুখবর টোয়েনটি ফোর ডটকম দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শগুলো হুবহু সামাজিক যোগাযোগ বিভাগে প্রকাশ করছে।

 

আসলে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে-এখন আমি কী করবো! আমার এখন কী হবে? এটা যতো না শরীরের সাথে লড়াই, তার চেয়ে অনেক বেশী মনের লড়াই বলেই আমার মনে হয়েছে।

নিজের সুস্থতার খবর জানিয়ে পোস্ট দেওয়ার পর অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কীভাবে এই লড়াই ‘জয়’ করলাম? সেটাই জানানোর চেষ্টা করছি।

মনে রাখতে হবে, করোনা ভাইরাস খুব অল্প লোককেই হাসপাতালে নিতে পারে। বিশ্বাস রাখুন, আপনি সেই ১০ শতাংশের একজন হবেন না। ৯০ শতাংশের মতোই বাসায় নিরাপদে থাকুন।

আমি চিকিৎসক নই, মনোবিদও নই। ফলে আমার কোনো পরামর্শ বিশেষজ্ঞ উপদেশ বলে ধরে নেবেন না। স্রেফ আমার অভিজ্ঞতাটা সবাইকে জানাচ্ছি। আমি প্রায় সিম্পটমহীন ছিলাম। এখন সারা বিশ্বেই সিম্পটমহীন করোনা রোগী সিংহভাগ। তাই আমার অভিজ্ঞতা কারো কাজে লাগলেও লাগতে পারে।

 

আমি কী করেছি:
• রিপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথে পরিবারের সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেছি। একটা আলাদা রুমে থেকেছি পরের রিপোর্ট নেগেটিভ না হওয়া অবধি। কতোদিন আলাদা থাকবেন, এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসরণ করবেন।
• আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্যও বাইরে যাইনি। আমার রুমের সাথেই বাথরুম ছিলো। সেটা একা ব্যবহার করেছি। বাথরুমে নিজের জন্য আলাদা সাবান, পেস্ট; সবকিছু আলাদা করে নিয়েছিলাম।
• খাবারের ক্ষেত্রে একটু কঠিন নিয়ম পালন করতে হয়েছে। আমার রুমের বাইরে একটা টেবিল রাখা ছিলো। সেখানে আমার পরিষ্কার করা প্লেট, বাটি রাখা থাকতো। বৌ এসে সেখানে খাবার দিয়ে যেতো। আমি ওটা ভেতরে নিয়ে নিতাম। আবার খাওয়া শেষে নিজে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ওখানে রেখে দিতাম।
• প্রতিদিন সকালে উঠে কম্পিউটারে কিছু গান শুনতাম। দুপুরের আগে চেষ্টা করতাম একটা সিনেমা দেখার। আবার বিকেলে একটা সিনেমা দেখতাম।
• দিনে একটা করে সিভিট ট্যাবলেট, একটা জিংক ট্যাবলেট খেয়েছি এবং একটা কাশির সিরাপ তিন বার খেয়েছি প্রতিদিন। সপ্তাহে একটা ভিটামিন ‘ডি’ ট্যাবলেট খেয়েছি। অধিকাংশ রোগীকে সাথে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। কিন্তু আমার উচ্চ রক্তচাপ আছে, সে জন্য কিছু ওষুধ খাই। তাই ওটা দেওয়া হয়নি। ওষুধ কোনোক্রমেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না।
• প্রচুর চা খেয়েছি; আদা দেওয়া। এ ছাড়া গরম পানি, আদা জ্বাল দেওয়া পানি এবং লবঙ্গ-এলাচ জ্বাল দেওয়া হালকা গরম পানিও খেয়েছি। প্রচুর গার্গল করেছি। এসব জ্বাল দেওয়া পানির ধোঁয়া নাক দিয়ে টানার কথা বলেছিলেন অনেকে; আমি খুব করতে পারিনি। করতে পারলে ভালো।
• সকাল ও বিকেলে ফুসফুসের কিছু ব্যায়াম করেছি। ইউটিউবে সুন্দর সুন্দর ব্যায়াম পাওয়া যায়। দেখে দেখে করতে পারেন। সময়ও ভালো কাটে।
• শেষ ক টা দিন আমার খুব মানসিক অস্থিরতা ছিলো। একটা দুটো প্যানিক অ্যাটাকও হয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ মনের ডাক্তার আমার পরিচিত। ওনার পরামর্শ নিয়েছি ফোনে। কিছু ট্রিকস বলেছেন। খুব কাজে দিয়েছে।

 

কিছু পরামর্শ
• রিপোর্ট পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করেন। প্রফেসর বা বড় ডাক্তার খুজতে যাবেন না। মনে রাখবেন, আপনার যে অসুখটা হয়েছে, তার ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল তরুন ডাক্তাররাও খুব ভালো জানেন। আপনার দরকার পরামর্শ ও সাপোর্ট। একজন ডাক্তারের সাথেই পুরোটা সময় যোগাযোগ রাখুন। তাকে প্রতিদিনের আপডেট জানান। পরিচিতদের মধ্যে খুজে বের করুন এই ডাক্তার।
• বাজারে পালস অক্সিমিটার বলে একটা যন্ত্র পাওয়া যায়। ৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা দামের পাওয়া যায়। আপনার এটা দরকার। কারণ, করোনা সংক্রমণে বড় ভয় হলো শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া। অনেক সময় নিজেও ধরা যায় না যে, এটা শুরু হচ্ছে। নিয়ম করে অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখুন। ৯৪-এর নিচে নামলে ডাক্তারকে জানান।
• একটা অ্যাম্বুলেন্স কথা বলে রাখুন। কোন হাসপাতাল কাছে, সেটা খোজ নিয়ে রাখবেন। দরকার হবে না। তারপরও দরকার হলে যেনো থতোমতো খেতে না হয়। আমার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের একটা সংগঠন এটার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।
• প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক খুব কাজের জিনিস। বাসায় বাজার করে দেওয়ার জন্য এবং ওষুধ কেনার জন্য একজন প্রতিবেশীর সহায়তা নিন। তিনি গেটের কাছে রেখে চলে যাবেন। আপনার বাসার কেউ পরে গিয়ে বাজারটা ভেতরে আনবে। টাকা বিক্যাশে দিন বা গেটের কালে পলিথিনে মুড়িয়ে রেখে দিন।
• বাসার সবার সাথে পালা করে কথা বলুন। তারা দরজার বাইরে থাকবে। আপনি একদম ঘরের আরেক প্রান্তে। এই অবস্থায় মাস্ক পরে কথা বলুন। মনে রাখবেন, চোখের দেখায় ভাইরাস ছড়াবে না। তবে বাচ্চারা যেনো দৌড়ে ঢুকে না পড়ে, সে জন্য বড় কেউ সাথে থাকবে।
• যে রুমটায় থাকবেন, ওটাতে জানালা থাকলে খুব ভালো হয়। জানালা দিয়ে বিশাল দুনিয়াটা দেখুন।
• সময় কাটানোটা চ্যালেঞ্জের; খুব চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে কাজহীন বসে থাকলেই মাথায় করোনা এসে ভর করে। তাই সবসময় কিছু না কিছু করবেন। লিখুন, পড়ুন, সিনেমা দেখুন। আমি হইচই সাবস্ক্রিপশন নিয়ে নিয়েছিলাম। এ ছাড়া লোকাল সার্ভার থেকে অনেক ছবি নামিয়েছি। নতুন বা ধীরগতির ছবি দেখতে পারিনি। মূলত কমেডি আর অ্যাডভেঞ্চার টাইপ ছবি দেখলে ভালো লাগবে।
• এক দু জন ভালো ফেসবুক বন্ধু বেছে নিন। তাদের সাথে চ্যাটিংয়ে বকবক করতে পারেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা টাইপ আজগুবি ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন। করোনার আলাপ কম।
• আগে থেকে ভীতু বলে চিহ্নিত বন্ধুদের থেকে এই কটা দিন দূরে থাকুন। ভয়ের আলাপ ভয় বাড়ায়। আপনাকে নির্ভয় থাকতে হবে।
• আমার মনোবিদ বলেছেন, ডোন্ট ফলো স্কোর অব করোনা। এটা ক্রিকেট নয়। ফেসবুক বা নিউজ সাইট খুলেই করোনার স্কোর, খবর দেখা বন্ধ রাখেন।
• ১৪ দিন পার হলে নেগেটিভ টেস্ট করাতে হবে। চেষ্টা করুন, এই সাথে বাসার সবার একটা টেস্ট করাতে।
• শেষ দিকে শরীরে দুর্বলতা ভর করতে পারে। বাসায় মুরগির স্যুপ টাইপের কিছু পুষ্টিকর খাবার বানাতে বলুন। কাজে দেবে। উচ্চরক্তচাপ না থাকলে খাবার স্যালাইনও খেতে পারেন।
• যার যার স্রষ্ঠার জন্য সময় দিন। ধর্ম পালন করুন। মন খুব শান্তিতে থাকবে।

সতর্কতা:
• এগুলো কেবলই যেসব লোকের কোনো গুরুতর সমস্যা নেই, তাদের জন্য পরামর্শ। নিজের শরীরে আগে থেকে কোনো জটিলতা থাকলে বাসায় না থেকে হাসপাতালে যাবেন।
• ডাক্তারকে সব খুলে বলবেন। কোনো কালে একটা আঙুলের ফোড়া হয়ে থাকলেও লুকাবেন না। ডাক্তারই বলতে পারবেন, আপনার জন্য কোনটা ভালো।

 

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় (লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক)