সারা বিশ্ব এখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্থ। মানুষকে করোনা থেকে মুক্তি দিতে বিজ্ঞানীরা তাই দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস ভাবে। এর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো টিকা আবিষ্কার।
সারাবিশ্বের গবেষকরা মূলত করোনা প্রতিরোধে SARS-CoV-2 ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যেই অন্তত ৩টি টিকা বাজারে আসবে এবং সাধারণ মানুষ তা হাতের লাগালে পাবে।
জাতিসংঘের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনার টিকা আবিষ্কারের জন্য সারা বিশ্বে প্রায় ১৭৩টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি টিকার মানবদেহে পরীক্ষা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, টিকা আবিষ্কার ও উৎপাদনের ৫টি ধাপের মধ্যে ৪টি টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই পর্যায়ে কয়েক হাজার মানুষের ওপর টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। পাশাপাশি সেটি কতটুকু নিরাপদ, কার্যকর, বড় ধরনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয় কিনা— এগুলো পর্যব্ক্ষেণ করা হচ্ছে। এখানে সফলতা পেলেই সাধারণত প্রাথমিকভাবে টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা তৃতীয় কোনো দেশে করতে হয়।
এছাড়া ১৩টি টিকা রয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। এসব টিকা কতটা নিরাপদ, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। এই পর্যায়ে কয়েকশ মানুষের ওপর টিকার পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এর নিরাপত্তা আর সঠিক মাত্রা নিরূপণের চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ১৯টি টিকার কার্যক্রম রয়েছে প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল টেস্টিং শুরু হয়েছে। এই ধাপে টিকাটি নিরাপদ কিনা তা কয়েকজন মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখা হয়। সেই সঙ্গে এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় কতটা প্রভাব ফেলে তাও যাচাই করা হয়।
১৪০টিরও বেশি টিকা এখনো মানবদেহে পরীক্ষা শুরু হয়নি। একে বলা হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। বিজ্ঞানীরা এখনো এসব টিকা নিয়ে গবেষণা এবং পশু বা প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করে কার্যকারিতা যাচাই করছেন।
টিকা আবিষ্কারে যারা এগিয়ে আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
সিনোফার্ম
উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট ও চীনা বিজ্ঞান একাডেমির গবেষণায় এবং চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের সহযোগিতায় তৈরি হচ্ছে সিনোফার্ম। যার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পরিচালিত হয়েছে।
সিনোভেক
কোভিড-১৯ এর আরেকটি টিকা আবিষ্কারের কাজ করছে চীনের কোম্পানি সিনোভেক। প্রথম দফার পরীক্ষাগুলোয় এই টিকাটি বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। এখন ব্রাজিল ও বাংলাদেশে প্রায় ৯ হাজার মানুষের ওপর টিকাটির তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ও মারডক চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউট
পুরোনো বিসিজি টিকার একটি অংশের ওপর ভিত্তি করে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা চালাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ও মারডক চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তবে এই টিকা সরাসরি কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করে না, কিন্তু এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ৪,১৭০ জন মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এই টিকা।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি
শিম্পাঞ্জির শরীরে সাধারণ সর্দি-কাশি তৈরি করে, এমন একটি ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন করে এই টিকাটি তৈরি করা হচ্ছে। এটি করোনাভাইরাসের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। শরীরের ভেতর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বুঝে কীভাবে করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে পরাস্ত করা যাবে সেইভাবে কাজ করে। সম্প্রতি এই টিকার সীমিত পরিসরে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন ৩০ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি চলছে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।
মডার্না
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি মডার্না ইনকরপোরেশন সার্স ও মার্স ভাইরাসের ওপর ভিত্তি করে কোভিড-১৯ এর টিকা তৈরি করছে। এটি একটি আরএনএ টিকা, যা এমআরএনএ-১২৭৩ নামে পরিচিত। আরএনএ টিকা হওয়ায় এটি সরাসরি মানব দেহে প্রয়োগের মাধ্যমে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে। এখন এটি দ্বিতীয় ধাপে আছে। আগামী ২৭ জুলাই প্রায় ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের দেহে এই টিকা প্রয়োগ করা হবে।
ক্যান্সিনো ও বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি
নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের অংশ ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে এই টিকা। ইতোমধ্যে পার করেছে ২য় ধাপ। লংকম বায়োফার্ম এবং চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের তত্ত্বাবধায়নে চলছে ডিএনএ ভিত্তিক কোভিড-১৯ এর এই টিকা তৈরির কাজ। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপ অতিক্রম করে টিকাটির দ্বিতীয় ধাপের ট্রায়াল চলমান আছে।
ফাইজার এবং বায়োনটেক
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার গবেষণা সহায়তায় চলছে ফাইজার এবং বায়োনটেক-এর করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরির কাজ। এটি এখন ২য় ধাপের ট্রায়ালে আছে।
জেনেক্সিন
দক্ষিণ কোরিয়ার জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেনেক্সিন কোভিড-১৯ এর ডিএনএ ভ্যাকসিন জিএক্স-১৯ পরীক্ষা করছে। সংস্থাটি ভ্যাকসিন বা প্লেসবো পেতে এলোমেলোভাবে ১৯০ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করেছে। এটি এখন ২য় ধাপে আছে।
রাশিয়ার গামালি ইনস্টিটিউট
রাশিয়ার গামালি ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি তৈরি করছে এই টিকা। রাশিয়ার এক সেনা হাসপাতালে ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এটি পরীক্ষা করা হয়। ২৮ দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর তাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তাদের শরীরে দারুণ কাজ করেছে এই টিকা। আবার ৪২তম দিনে ওই স্বেচ্ছাসেবীদের পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তর।
জাইডাস ক্যাডিলা
ভারতীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী জাইডাস ক্যাডিলা একটি ডিএনএ ভিত্তিক টিকা তৈরি করছে। গত ৩ জুলাই মানব শরীরে পরীক্ষা শুরুর অনুমোদন পায় তারা। এখন প্রথম ট্রায়াল শেষ করে দ্বিতীয় ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারতের করোনা টিকা নিয়ে আশাবাদী মাইক্রোসফট কর্তা বিল গেটস। কোভিড টিকা তৈরি করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য করছে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
আর্টারাস থেরাপিউটিক্স
সিঙ্গাপুরে ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সংস্থা আর্টারাস থেরাপিউটিক্স এবং ডিউক-এন ইউএস মেডিক্যাল স্কুল একটি এমআরএনএ ভিত্তিক টিকা তৈরি করেছে। টিকার অণুগুলোর ‘স্ব-প্রতিলিপি’ ডিজাইনের ফলে প্রাণী পরীক্ষাগুলোতে প্রতিরোধ ক্ষমতা জোড়াল হয়েছে। গত ২১ জুলাই, মানুষের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে টিকাটির পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছে সিঙ্গাপুর।
এসব ছাড়াও লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজ ডিএনএ ভিত্তিক টিকার দ্বিতীয় ট্রায়াল শেষ করেছে। বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান করোনার টিকা আবিষ্কারের জন্য নিরলস কাজ করছে। তবে কম সময়ে কে সফল হচ্ছেন এটাই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস ও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকার
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition