করোনাভাইরাস চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এর ফলে সৃষ্ট মহামারীতে নাকাল বিশ্ববাসী। এ বছরের শুরু দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ভাইর্যাল হয়। চাইনিজ এক মহিলা বাদুড়ের সুপ খাচ্ছে! চারদিকে রটে গেল বাদুড় থেকেই করোনা ভাইরাস এসেছে। কারণ, চাইনিজরা এভাবে বাদুড়ের স্যুপ খায়। যদিও পরে জানা গেলো যে, Wang নামের এক মহিলা বাদুড়ের সুপের সেই ছবি ২০১৬ সালে অনলাইনে দিয়েছিল। মজার বিষয় হলো- সেই মহিলা চাইনিজও নযন। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের পালাউ নামের একটি দ্বীপের অধিবাসী তিনি। পালাউ রাষ্ট্রটি ৫০০টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেরিটোরিয়াল প্রটেকশনের অধীনে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। আরেক অর্থে আমেরিকান নাগরিকও!
সেই থেকে রটে গেলো- বাদুড় থেকে করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। চাইনিজরা বাদুড় খায়। সুতরাং চাইনিজরা করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোলান্ট ট্রাম্পও মস্করা করে করোনা ভাইরাসকে বললেন- ‘চাইনিজ ভাইরাস’!
রটনাটি ঘটনা আকারে এখনো ১০০ ভাগ প্রমাণিত না হলেও তা ৯০ ভাগ সত্য। বাদুড় থেকে এই ভাইরাস আরেকটি ইন্টারমিডিয়ারি প্রাণীর দেহে মিউটেড বা পরিবর্তিত হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। যদিও বিজ্ঞানীরা সেই মাঝের প্রাণীটির সন্ধান এখনো পায় নি।
কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি, এতো কিছু ঘরের আশেপাশে থাকতে বনে-বাদাড়ে, গুহায় থাকা বাদুড় কেন মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি রোগজীবাণু ছড়ায়। বিশেষ করে এতো এতো ভাইরাস।
তাহলে কি মানুষের উদ্ভট খাদ্যভ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিধনই কি কোভিডের মতন ভয়ঙ্কর রোগ ডেকে আনছে?
শুধু কি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)! গত পঞ্চাশ বছরে যতগুলো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মানুষের শরীরে দেখা গেছে, তার সিংহভাগের উৎস বাদুড়। ইবোলা থেকে নিপা, সার্স থেকে মারবার্গ, হেন্ডরা থেকে রেবিস, মার্শ থেকে লাসা, সবগুলোই বাদুড় থেকে আসা। বাদুড়কে বলা হয় সুপার হোস্ট অফ জোনোটিক ভাইরাস।
এ পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে বাদুড়ের শরীরে ১৭১ ধরনের ভাইরাস থাকে । তারমধ্যে ৬২ ধরনের ভাইরাস মানুষের শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে।
এক ভাইরাসের সংক্রমনে মানুষ মারা যাচ্ছে, আর বাদুড়ের শরীরে এতগুলো ভাইরাস! তাহলে বাদুড়ের কেন কিছু হয় না? বাদুড় কেন করোনা ভাইরাসে কিংবা ইবোলায় মরে না? বাদুড় নিজে কেন অসুস্থ হয় না?
উত্তর খুঁজতে একটু পেছনে যেতে হবে। বিবর্তনে বাদুড়ের উৎপত্তি ৬৪ মিলিয়ন বছর আগে। বাদুড় এবং মানুষ একই শ্রেণীভুক্ত ছিল আশি মিলিয়ন বছর আগে। তখন আমরা একই Mammalian শ্রেণীর ছিলাম। Mammal মানে যার mammary গ্ল্যান্ড বা স্তন্য আছে। যে শ্রেণীর প্রাণীরা তাদের বাচ্চাদের দুগ্ধ পান করায়। বাদুড়ই ম্যামালদের মধ্যে একমাত্র যে উড়তে পারে, কিন্তু বাচ্চাদের দুধ পান করায়। মানুষ সত্তর মিলিয়ন বছর আগে Primate হিসাবে আলাদা হয়ে যায় ম্যামালদের কাছ থেকে। এই বিবর্তনের পার্থক্যের কারণে একটি মজার কথা বলে নিই যে, বাদুড় থেকে সরাসরি কোনো ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে না। বাদুড়ের শরীর ভাইরাসগুলোর পোষক, কিন্তু সেই ভাইরাসগুলো পরবর্তীতে অন্য প্রাণীর মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে আক্রমণের উপযুক্ত হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। করোনা ভাইরাসও ব্যতিক্রম নয়।
বাদুড়ের শ্রেণীগত বৈজ্ঞানিক নাম Chiroptera! গ্রিক cheir মানে hand; pteron মানে wing । এক করলে বাদুড় মানে Hand-Wing ! বাদুড়ের পাখা আছে। বাদুড়ের হাত আছে, সে হাতের চারটি আঙ্গুল আছে। আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুলের মতো আঙ্গুলও আছে! হয়তো এসব আগে জানতেন না। বাদুড়ের প্রসারিত হাত এবং শরীরের মাঝখানের অংশ খুব পাতলা চামড়া দিয়ে তৈরি। এই চামড়াই তার পাখা, যা দিয়ে বাদুড় ঘন্টায় একশো মাইল উড়তে পারে। মানুষ তার দুটো হাত প্রসারিত করে পাখার মতো করলে বাদুড়ের মতোই লাগে! অ্যামেরিকান বিখ্যাত কমিক ব্যাটম্যানের পোশাকের ছবিটি একবার মনে করুন!
আম, কলা, ডুমুর, পেঁপে, খেজুর, কোকো সহ প্রায় ৩০০ ধরনের ফলমূল খায় বাদুড়। কোনো ফলে কোনো পাখি বা প্রাণীর খাওয়ার এমন ক্ষত, ঠোকর কিংবা কামড় দেখলে ফলটি খাবেন না। বলা হয়, হাত-পা-ওয়ালা চেয়ার-টেবিল ছাড়া চাইনিজরা জগতের হাত-পা-ওয়ালা যে কোনো প্রাণী খায়! আর বাদুড়রা খায় শতাধিক ফলমূল আর পোকামাকড়। পোকামাকড়ের মধ্যে বাদুড় ভীতি সবচেয়ে বেশি। কারণ, রাতের অন্ধকারে বাদুড় পোকামাকড় খায়। তাই রাতেও পোকামাকড়রা বাদুড়ের হাত থেকে বাঁচতে পারে না।
১২৩০ প্রজাতির বাদুড় আছে। তার চেয়ে একটু বেশি রোডেন্টগুলো! বাদুড় একাই প্রাণিজগতে বৈচিত্রে দ্বিতীয়! বলা হয় জগতের ২০% ম্যামাল হলো একা বাদুড়রাই।
বাদুড়কে নিয়ে এতো কিছু বলার কারণ- তার বৈচিত্রতার মধ্যে লুকিয়ে আছে তার এত ভাইরাস থাকার কিছু কারণ। প্রাণিজগতে যে যত বিচিত্র, তার দেহ তত বেশি একই সাথে বিচিত্র জীবাণুর পোষক কিন্তু জীবাণুগুলোর সহনীয়। একই পরিবারভুক্ত হয়ে বিবর্তনের দীর্ঘ সময় জীবাণুদের সাথে তাদের সহাবস্থান সহনীয় করে তোলে। আধুনিক মানুষ প্রজাতি বেশি পুরোনো নয়, এবং বৈচিত্রময় দেহের নয়! white nose syndrome সহ কয়েকটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বাদুড়ের শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে। কিন্তু বাদুড়ের দেহে থাকা আশিভাগ জীবাণু তাকে আক্রান্ত করতে পারে না, কিন্তু মানুষসহ অন্য প্রানীদের করতে পারে। কেন এমন হয়, তা নিয়ে এবার আলোচনা।
খুব সহজ করে বলি : বাদুড়ের শরীরের দুর্বল জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শারীরিক গঠনের কারণে ভাইরাসগুলো তার দেহে থাকা সত্ত্বেও বাদুড় আক্রান্ত হয় না। শুনতে খুব অবাক লাগছে, তাই না! ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে জীবাণু শরীরকে সহজে কাবু করে ফেলে। বাস্তবে হয়ও তাই। তাহলে বাদুড়ের ক্ষেত্রে কী ব্যতিক্রম, কেন ব্যতিক্রম এবং কীভাবে এটি ঘটে!
বাদুড় তার শরীরে ভাইরাসগুলো আশ্রয় দেয়, কিন্তু নিজের শরীরকে তাদের আক্রমণ করতে প্রশ্রয় দেয় না। এটি পাঁচ ভাবে দেয় না-
এক. বাদুড় মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে থেকে এই ভাইরাসগুলোর হোস্ট বা পোষক হিসাবে মানিয়ে নিয়েছিল শারীরিক ভাবে।
দুই. বাদুড় যখন পাখা নাড়ে, তখন তার পাখাটিকে খুব দ্রুত নাড়তে হয়। এই দ্রুত পাখা নাড়াটি তার শরীরে জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। কীভাবে তা করে, নিচে তা বলছি।
তিন. বাদুড়ের শরীরে ইন্টারফেরন নামক একটি রাসায়নিক উপাদানের তিনটি ধরন থাকে, যা তার ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মানুষ সহ অনেক ম্যেমালদের তা মাত্র একটি ধরন।
চার. বাদুড় যখন উড়ে এবং অনেকক্ষণ – অনেকদূর পর্যন্ত উড়তে পারে, তখন তার মেটাবলিক রেট খুব বেড়ে যায়, যা ভাইরাসগুলোর বৃদ্ধিকে এগোতে না দিয়ে থামিয়ে দেয়।
পাঁচ. বাদুড়ের উড়ার সময় তার শরীরের তাপমাত্রা ৪১ থেকে ৪৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই তাপমাত্রাও ভাইরাসকে মেরে না ফেললেও কপি করা থেকে বিরত রাখে। এবারে পাখার ওড়াওড়ি কীভাবে ভাইরাসের হাত থেকে বাদুড়কে রক্ষা করে, মজার এই অংশটি ব্যাখ্যা করবো।
বাদুড় যখন উড়ে, মিনিটে একশোর বেশি বার পাখা ঝাপটাতে হয়। এতে বাদুড়ের অনেক এনার্জির দরকার পড়ে। তাতে কোষের DNA এর কিছু অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আঘাতের ফলে DNA থেকে উপাদানগুলো বেরিয়ে ঘুরতে থাকে রক্তে। শরীরের নিয়ম হল বাহির থেকে কোনো জীবাণু ঢুকলে বা ইনফেক্টেড করলে শরীর তার নিজেকে প্রতিরক্ষা করতে একটি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। এই প্রতিক্রিয়াকে বলে Inflammation । যেমন- নিউমোনিয়ার কথা শুনেছেন। করোনা ভাইরাসের কারণে এটিও সবার মুখে মুখে। নিউমোনিয়া ইনফেকশন নয়, এটি একটি ইনফ্লামেশন। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি অত্যাধিক বেড়ে গেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাও অত্যাধিক বেড়ে যায়। তার প্রতিক্রিয়ায় ফুসফুস তখন তার নরমাল কাজটাই করতে পারে না। ভাইরাস যত না ক্ষতি করে, শরীর তার ইনফ্লেমেটরি রি-একশন করে শরীরের তেরোটা বাজিয়ে দেয়। তার মানে দাঁড়ালো, শরীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে যত জোরালো এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, শরীরে তার ইনফ্লেমেশন তত বেশি হবে। বাদুড়ের শরীরে অতিরিক্ত পাখা ঝাপটানোর কারণে DNA ভেঙে ঘুরে বেড়ানো উপাদানগুলো শরীরের ইমিউনিটি কমিউনিটিকে বার বার ইনফ্লেমেশনের সংকেত দিয়ে একদিকে শরীরের পাল্টা প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, সহনীয় করে তোলে অথবা দুর্বল করে রাখে। মানে উপাদানগুলোকে ইনফেক্টেড ভেবে শরীরের ইমিনিটি সেলের দৌড়ে আসার কারণে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা ইনফ্লেমেশন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়। তখন একটি ভাইরাস ঢুকলেও কিংবা থাকলেও বাদুড়ের ইমিনিটি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সাড়া দেয় না, ইনফ্লেমেশন ঘটায় না, প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা দেখায় না, দেখালেও কম দেখায়, সহ অবস্থান মেনে নেয়। এভাবে অনেক দিন ভাইরাসগুলো বাদুড়ের শরীরে থাকলেও শরীর জেনে যায় এবং মেনে নেয় তাদের এই সহ অবস্থান। এ ভাবে অনেক ধরনের ভাইরাস বাদুড়ের দেহে বাসা বাঁধলেও বাদুড়ের শরীর ভাইরাসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে। বাদুড় অসুস্থ হয় না ভাইরাসগুলোতে, কিন্তু মানুষের দেহে ঢুকলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়।
লেখক: ড: অপূর্ব চৌধুরী, চিকিৎসক এবং লেখক, ইংল্যান্ড।
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition