কাঁঠাল : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খাদ্য অনুষঙ্গ

প্রকাশঃ ২০-০৭-২৪ ১০:২৭:৩৫ এএম
আপডেটঃ ২০২৪-০৪-১৮ ১০:১১:৫৩ পিএম
লেখকঃ বাশার খান
কাঁঠাল : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খাদ্য অনুষঙ্গ
অনলাইন থেকে সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালে কাঁঠাল ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছিল! জানি, ওপরের লাইনটি পড়েই চমকে গেছেন আপনি। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবেই এ তথ্যটির যৌক্তিকতা রয়েছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে দু-এক চরণ কাঁঠাল-কীর্তন করা যাক। বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় ফলের মধ্যে অন্যতম হলো কাঁঠাল। এটি বাংলাদেশের জাতীয় ফল। গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে এটি গ্রাম-শহর সব জায়গায়ই পাওয়া যায়। আবার দাম সুলভ হওয়ায় এটি ধনী-গরিবসহ সর্বস্তরের মানুষই কিনতে পারেন। কাঁঠালের আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা হলেও ফলটি এখন ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়। তবে দেশের মধ্যে নওগাঁ, দিনাজপুর, সাভার, মধুপুর ও সিলেট এর প্রধান এলাকা। কাঁঠালগাছে ফুল আসে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে এবং ফল পাকে মে-জুলাই মাসে। সেই হিসাবে এখন কাঁঠালের সময়।


বাঙালির জনপ্রিয় ফল কাঁঠালের সঙ্গে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যুদ্ধের ৯ মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর জন্য মে-জুন-জুলাই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মে মাসে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা জুন-জুলাইয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ১১ সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গেরিলা হামলা চালাতে থাকেন। এ হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী ব্যতিব্যস্ত এবং কোথাও কোথাও দিশেহারাও হয়ে পড়ে।

 

এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য ছাত্র-যুবক সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যান। উদ্দেশ্য, প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ছাত্র-যুবকদের বিভিন্ন শিবিরে ভাগ করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অধিকাংশ প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল ভারতের বন ও পাহাড়ি এলাকায়। সেখানে প্রশিক্ষণরত ছাত্র-যুবকদের নিয়মিত খাবার সরবরাহ সহজ ছিল না। আবার এত এত লোকের খাবারের জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। ফলে বন ও গাছগাছালি পরিবেষ্টিত এলাকার ক্যাম্পগুলোতে ছাত্র-যুবকদের প্রধান পার্শ্বখাবার ছিল আশপাশের বনের কাঁঠাল। আবার কম দামে কিনেও খাওয়া যেত ফলটি। মুক্তিযোদ্ধা ড. শেখ বাতেনের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, ‘...ট্রানজিট ক্যাম্পগুলোতে খুব কষ্ট হতো। খাবারদাবারের কষ্ট। কষ্ট মানে, একটা ক্যাম্পে, ক্যাম্পটার নাম হাফানিয়া, সেখানে যদি এক রোববারে খাওয়া দিত, তাহলে পরের দিনের খাবার সিরিয়াল আসতে মঙ্গলবার হয়ে যেত। সুতরাং পেটের খিদায় লোকজন অস্থির হয়ে যেত। ত্রিপুরার একটা সুবিধা ছিল কম দামে কলা, ২০ পয়সায় একটা কলা কিংবা আট আনায় একটা কাঁঠাল পাওয়া যেত। কাঁঠাল খাওয়ার পরে যে বিচিগুলো থাকত সেগুলো চুলার মধ্যে দিয়ে অনেক ছেলেরা খেত, আমরাও খেয়েছি।’ 

 

কাঁঠাল খেয়ে তার বিচিও ফেলেননি প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধারা। তাতে একদিকে যেমন ক্ষুধা নিবারণ হয়েছে, পাশাপাশি পেয়েছেন পুষ্টির জোগান। ত্রিপুরা ক্যাম্পগুলো ছিল বনজঙ্গল এলাকায়। তাই ওখানে সহজেই পাওয়া যেত কাঁঠাল। ভাত, রুটির বিরতিতে কাঁঠাল খেয়েই দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে প্রস্তুতি নেন মুক্তিযোদ্ধারা।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণকালীন খাবারের সংকটের তীব্রতা অনুভব করা যায়, শহীদজননী জাহানারা ইমামের স্মৃতিকথা একাত্তরের দিনগুলিতে উল্লিখিত শহীদ শাফী ইমাম (রুমী) বীর বিক্রমের বক্তব্যে। একাত্তরের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে গেরিলা অপারেশনের জন্য ঢাকায় আসেন রুমী। ৮ আগস্ট, রোববার ১৯৭১, গোপনে এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় যান। সেখানে মা জাহানারা ইমামের সঙ্গে নানা কথাবার্তায় উঠে আসে ত্রিপুরার ক্যাম্পে খাবারের বিষয়টি। রুমীর ক্যাম্প ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরের পাহাড়ি এলাকায়। জাহানারা ইমাম ছেলেকে থাকা এবং খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রুমী জানান, ‘...খাওয়াদাওয়ার কথা আর জিগ্যেস করো না। ওইটার কষ্টই সবচেয়ে বেশি। ভাত আর ডাল। ...সকালের নাশতা রুটি আর ঘোড়ার ডাল। ...চোকলা-মোকলাসুদ্ধ একধরনের গোটা গোটা ডাল, নর্মাল টাইমে বোধ হয় ঘোড়াকে খাওয়ানো হয়। ...জানো আম্মা, কত দিন সে রুটির মধ্যে সেঁকা পোকা পেয়েছি।’ 

 

‘রুটিকে পোকা পেয়ে কী করতিস? ফেলেদিতিস?’ মা জাহানারা ইমামের এমন প্রশ্নের উত্তরে রুমী জানান, ‘ফেলে দেবো? তুমি পাগল হয়েছ আম্মা? সেঁকা পোকাটা নখে খুঁটে ফেলে দিয়ে রুটি খেয়ে নিতাম।’ ছেলের এমন নিম্নমানের খাবার খাওয়ার কথা শুনে মায়ের যে চোখ ভিজেছে এ কথা সহজেই অনুমেয়। 

 

স্বাধীনতাকামী বাংলা মায়ের ছেলেরা একাত্তরে ভুলে গিয়েছিলেন আরাম-আয়েশ। ভুলে গিয়েছিলেন পেট ভরে খাবারের কথাও। ভারতের মেলাঘরে পাহাড়ি এলাকায় তখন অনেক কাঁঠালগাছ ছিল। এখনো সেখানে প্রচুর কাঁঠালগাছ দেখতে পাওয়া যায়। রুমীর দলের টগবগে তরুণ যোদ্ধাদেরও পাহাড়ের টিলার তাঁবুতে খাবারের সংকটকালীন ক্ষুধা নিবারণের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলাঘরের কাঁঠাল। রুমী তাঁর মাকে জানান, ‘... ঐ (নিম্নমানের) খাবার যে কী অমৃতের মতো লাগত। ওই খাবারও তো সব দিন জুটত না। কত দিন গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে খেয়েছি। মাঠ থেকে তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস এসব তুলে খেয়েছি।’ 

 

জুন-জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অপারেশন পরিচালনা করে যুদ্ধের কৌশল ও নিজেদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করতেন। তাই সময়মতো অন্তত ডাল-ভাত খাওয়ারও সুযোগ পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুবই কঠিন ছিল। কখনো কখনো বনের কাঁঠালই ছিল ভরসা। বর্তমানে ঢাকা-২০ আসনের সাংসদ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ধামরাই থানা কমান্ডার বেনজীর আহমেদ লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে জানান, ‘আমরা তখন হাতিমারা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ পাওয়ার অপেক্ষায়। একদিন বাঙালি আর্মির একজন ক্যাপ্টেন (ক্যাপ্টেন আলম বা অন্য কেউ, সঠিক নাম মনে করতে পারছিলেন না) এসে বললেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান আর্মির বাংকারে অপারেশন চালানো হবে। কয়েকজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা দরকার। তখন আমি এবং আরও কয়েকজন সে অপারেশন যোগ দিই। আমাদের কাজ ছিল যাঁরা ফ্রন্টলাইনে অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের হেল্প করা। এরপর অপারেশনটি সফলভাবেই পরিচালিত হয়। বাংকারের ভেতরে থাকা হানাদার সদস্যদেরও মারা হয়। অপারেশন শেষে সবার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, সবাই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। এ সময় পাকা কাঁঠালের গন্ধ আমাদের নাকে লাগে। আশপাশে অনেক গাছ ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁঠালগাছটির খোঁজ পাই এবং কাঁঠাল পেড়ে খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করি। তারপর দ্রুতই ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হই।’

 

কাঁঠাল শুধু ভারতে প্রশিক্ষণকালীনই মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ছিল না, এরপর গেরিলা যুদ্ধকালীন খাদ্য জোগানেও রেখেছে অনন্য ভূমিকা। তাই এ ফলটি শুধু বাংলাদেশের জাতীয় ফলই নয়, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খাদ্য অনুষঙ্গ। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কথ্য ইতিহাস সংগ্রহ করলে এবং তথ্যানুন্ধান অব্যাহত রাখলে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হয়। 

Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam

Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon

SHOKHOBOR24.COM

2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201

TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA

COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition