কবিগুরুর রসিকতা (পর্ব-এক)

প্রকাশঃ ২০-০৫-০৮ ৪:১৯:৪৫ এএম
আপডেটঃ ২০২৪-০৫-০৬ ১:১৫:০৬ এএম
লেখকঃ তাপস রায়
কবিগুরুর রসিকতা (পর্ব-এক)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)

আজ ২৫ বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিনে কবিকে নানা ভাবে স্মরণ করা হচ্ছে। সুখবর টোয়েনটি ফোর ডটকম কবিকে নিয়ে বেশকিছু লেখা প্রকাশ করছে। এই আয়োজনে থাকছে কবির জীবদ্দশায় বিভিন্ন পরিপেক্ষতে যে রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় তারই কিছু টুকরো ঘটনা। 

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বকবির নানা রঙ্গ রসিকতা নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকার লেখক-সাংবাদিক তাপস রায়। এ বিষয়ে তার বই 'রসিক রবীন্দ্রনাথ'। বিশ্বকবির অনুরাগিদের জন্য তার সেই বই থেকে আমরা আমাদের মাসিক ম্যাগাজিন 'সুখবর'-এ একটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছি। আজ আমাদের অনলাইন পাঠকদের জন্য প্রকাশ করছি সেই ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব। 

 

রাধাকৃষ্ণ
ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মজার খেলা ছিল শোভারামকে নিয়ে। শোভারাম মস্ত পালোয়ান। ঠাকুরবাড়িতেই থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিকটে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলতেন ‘রাধাকৃষ্ণ’।

এতে শোভারাম খুব রেগে যেতেন। আসলে এ তাঁর রাগ নয়, রাগের ভান। কারণ তিনি যত রাগতেন, রবীন্দ্রনাথ মজা পেয়ে তাঁর কানের কাছে ‘রাধাকৃষ্ণ’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন।
শোভারাম ছিলেন রাধাকৃষ্ণের পরম ভক্ত। প্রিয় দেবতার নাম যাতে বারবার উচ্চারিত হয় এ জন্য তার এই ফন্দি। আর বালক রবীন্দ্রনাথও এতে ভীষণ আনন্দ পেতেন।

 

নিজের হাত সামলাও
এই ঘটনা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর সম্পর্কটা অনুমান করে নেয়া যেতে পারে। স্কুল থেকে ফিরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদি কাদম্বরী দেবীর কাছে ছুটে যেতেন। বৌদি তাকে মায়ের মতো যত্ন করতেন। তাঁর স্নেহে এবং প্রীতির বাঁধনে ধরা পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
তাই কোনোদিন কাদম্বরী দেবী কোথাও গেলে রবীন্দ্রনাথের বেজায় অভিমান হতো। ঘর থেকে নিজেই দামি জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার সৃষ্টি করতেন। বলতেন, তুমি গেলে তোমার ঘর সামলাবে কে? আমি কি চৌকিদার!
কাদম্বরী দেবী কিন্তু সব বুঝতেন। তিনিও রাগ দেখিয়ে বলতেন, তোমাকে আর ঘর সামলাতে হবে না, নিজের হাত সামলিয়ো।

 

বিলেত যাত্রা
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৮।
পুনা*য় চেপে কিশোর কবি বিলেত যাত্রা করলেন। সমুদ্রে ভ্রমণকালে অনেকের সমুদ্রপীড়া দেখা দেয়। বড় বড় ঢেউয়ের কারণে জাহাজের দুলুনিতে এমন হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমুদ্রপীড়ায় ছয়দিন বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না। এ সময়ে অসুস্থতার বর্ণনা কবি এভাবে দিয়েছেন :
‘ইঁদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি, মাথাটা যেন ধার করা, কাঁধের সঙ্গে বড়ো একটা খাপ খাচ্ছে না।’
*পুনা : জাহাজ

 

বিলেতে নাচ
তরুণ রবীন্দ্রনাথ বিলেতের কেতাদুরস্ত সমাজে দ্রæত অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। নাচ গান পার্টি চলছে। ইংরেজ তরুণীর বাহুলগ্ন হয়ে কবি নাচের আসরে যোগ দিচ্ছেন। বিশেষ আলাপ আছে এমন মেয়েদের সঙ্গে নাচতে তাঁর মন্দ লাগত না। এ প্রসঙ্গে নিজেই লিখেছেন :
‘মিস অমুকের সঙ্গে আমার বেশ আলাপ ছিল, আর তাঁকে বেশ দেখতে, তাঁর সঙ্গে আমি ‘গ্যালপ’ নেচেছিলাম, তাই জন্যে তাতে আমার কিছু ভুল হয়নি। কিন্তু মিস অমুকের সঙ্গে আমি ‘ল্যানসার্স’ নেচেছিলাম, তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না, আর তাঁকে অতি বিশ্রী দেখতে। ... তাঁর সঙ্গে নাচতে গিয়ে যত প্রকার দোষ হওয়া সম্ভব, তা ঘটেছিল। যেমন তাস খেলবার সময় খারাপ পার্টনার পেলে তার দলের লোক ভারী চটে যায়, তেমনি নাচের সময় খারাপ পার্টনার পেলে মেয়েরা ভারী চটে যায়। তিনি বোধহয় নাচবার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন। নাচ ফুরিয়ে গেলে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, তিনিও নিস্তার পেলেন।’

 

বিলেতে মিস মুল
বিলেতে মিস মুল কবির প্রেমে পড়লেন। কবি যতই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন সম্ভব হয় না। কবিকে ছাড়া তিনি করো সঙ্গে নাচতে চান না, এমনকি অন্য কারো সঙ্গে বেড়াতে যেতেও তাঁর বেজায় আপত্তি। অথচ মিস মুলের আরেকজন প্রেমিক ছিলেন। তিনি ভারতীয়, নাম রাজনারায়ণ। এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন।
একদিন মিস অসওয়াল্ডের সঙ্গে কবি চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়েছেন। এই ইংরেজ রমণী কবির গুণমুগ্ধ। প্রদর্শনীতে হঠাৎ মিস মুলের সঙ্গে দেখা। তিনি কবিকে দেখেই সহাস্যে এগিয়ে এসে কবির কোমর জড়িয়ে ধরলেন। তারপর অসওয়াল্ডকে পাত্তা না দিয়ে কবিকে নিয়ে দ্রুত হেঁটে যেতে যেতে বললেন, ‘I am quick at everything’
রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নিজেও সপ্রতিভ হয়ে উঠেছেন। হেসে বললেন ‘Quick to forget?’

 

রবীন্দ্রের পর কবীন্দ্র
কবিগুরু তখন কালিমপঙে। একদিন সকালে ডাক এলো। সে এ প্রকার বোঝা। কবির জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, জন্মদিনের প্রণামের চিঠি, ভক্তের লেখা কবিতা ইত্যাদি।
কবিগুরু হঠাৎ মৈত্রেয়ী দেবীকে বললেন, তুমি একটা কবিতা লিখলে না যে? কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার ভক্তি অসম্ভব কমে যাচ্ছে। ওইতো কাগজ কলম রয়েছে, চট করে, ‘হে রবীন্দ্র কবীন্দ্র’ বলে একটা লিখে ফেল না। আমার নামটা ভারী সুবিধের, কবিদের খুব সুবিধে হয়ে গেছে। মিলের জন্য হাহাকার করে বেড়াতে হয় না। রবীন্দ্রের পর কবীন্দ্র লাগিয়ে দিলেই হলো।

 

পয়সা না থাকার সুবিধা
বোলপুর থেকে কবি কলকাতা যাচ্ছেন। বর্ধমান এসে একটা লেমনেড খেয়ে বিপদে পড়ে গেলেন। কারণ সঙ্গে পয়সা নেই। সঙ্গীরা অন্য কামড়ায়। এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে দেখে বিক্রেতা পয়সা না নিয়েই চলে গেল। এরপর থেকে কবি সঙ্গে কিছু পয়সা রাখতেন।
একদিন ঘটনাটি শুনিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীকে রসিকতা করে বললেন, কাছে পয়সা না থাকাটাই বিশেষ সুবিধের। কোন কিছুর দরকার পড়লে তখন এ-পকেট ও-পকেট দু’একবার হাতড়াতে শুরু করলে, সঙ্গে যিনি থাকেন; বিশেষ করে তোমাদের মতো করুণহৃদয়া হলে তো কথাই নেইÑ বলে ওঠেন, ব্যস্ত হবেন না। ও আমি দিয়ে দিচ্ছি।
বলা বাহুল্য, বিন্দুমাত্র ব্যস্ত হই নি, তবু মুখের ভাবটা যথাসাধ্য নিরুপায় এবং করুণ করে বলা যায়, আহা তুমি আবার কেন কষ্ট করে; না, না, সে কি! এই রকম করে বেশ ভালোভাবেই চলে যায়।

 

ভাঙা ছাতা
একদিন সুধাকান্ত রায়চৌধুরী* এবং অনিলকুমার চন্দ্রের* বাইরে গিয়ে ফিরতে রাত হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিন্তিত হলেন। পাহাড়ি পথ। পথে ভালুকের উৎপাত আছে।
অবশেষে বেশ রাত করে তারা দু’জন ফিরলেন। সুধাকান্তবাবু বললেন, অন্ধকার জঙ্গলে পথ হাতড়ে আসতে হয়েছে। একবার তো খাদেই পড়ে গিয়েছিলাম প্রায়। ছাতায় ভর দিয়ে তাল সামলাতে হয়েছে। ফলে ছাতাটাই ভেঙে গেছে। তা যাক, প্রাণ যে রক্ষা পয়েছে এই ঢের।
কবিগুরু কিন্তু এসব কথা বিশ্বাস করলেন না। উল্টো বললেন, শান্তিনিকেতনে পৌঁছতে পৌঁছতে এই গল্প আরও থ্রিলিং হয়ে উঠবে।  চারদিক থেকে চারটে ভালুক তেড়ে আসছে। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, শুধু তাদের সাদা দাঁত। মাঝখানে এই দুই বীরপুরুষ, আর হাতে ডাক্তার সেনের ছাতা!
পরদিন সকালে বৃষ্টি হচ্ছে। পথ পিচ্ছিল। ডাক্তার সেন* গাড়ি নিয়ে বের হবেন। হঠাৎ কবিগুরু বললেন, ড্রাইভারের হাতে ছাতাটা দিয়ে দে। গাড়ি যদি স্লিপ করে ছাতা দিয়ে ঠেকাতে ঠেকাতে যাবে।
*সুধাকান্ত রায়চৌধুরী : কবির পার্সোনেল সেক্রেটারি
*অনিলকুমার চন্দ্র : কবির সেক্রেটারি
*ডাক্তার সেন : মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী

 

দুধ মাখানো
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাকরদের সঙ্গেও হাস্যকৌতুক করতেন। একবার তিনি নিজেই বলেছেন, ঠাট্টা না করতে পেলে আমার চলে না সে চাকর দিয়ে। প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।
একদিন খেতে বসে বনমালীকে* বললেন, বনমালী খাওয়া চলছে কেমন?
: আজ্ঞে তা ভালোই চলছে। দিদিমণি আবার আমায় দুধ খাওয়াচ্ছেন।
দুধ খাওয়াচ্ছেন কেন, রবীন্দ্রনাথ বললেন, এর চেয়ে দুধ মাখালেই তো পারতেন। খেয়ে তো রঙের বিশেষ উন্নতি হচ্ছে না।
আরেকবার বনমালীর কাছে চা চেয়েছিলেন। আনতে দেরী হওয়ায় বলেছিলেন, ‘চা-কর বটে, কিন্তু সু-কর নয়।’
*বনমালী : কবির পুরাতন ভৃত্য

 

চাঁদ ঢেকে দে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘুমাচ্ছেন। জানালা খোলা। চঁাঁদের আলোয় ঘর ভরে উঠেছে। আলো মুখের উপর এসে পড়ায় তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। মহাদেবকে* ডেকে বললেন, ওরে মহাদেব, চাঁদটা একটু ঢেকে দে।
মহাদেব গুরুদেবের কথা শুনে কী করবে ভেবে পায় না। চাঁদ তো অনেক দূরে। তাকে কীভাবে ঢাকবে?
রবীন্দ্রনাথ তখন হেসে বললেন, জানালাটা বন্ধ কর। তাহলেই চাঁদ ঢাকা পড়ে যাবে।
*মহাদেব : কবির ভৃত্য  

 

জোরালো সব নাম
কাছাকাছি যারা থাকতেন কবিগুরু প্রায়ই তাদের নতুন নামকরণ করতেন। পার্সোনেল সেক্রেটারি, এমনকি অ্যাটেন্ডেন্টদেরও রসিকতা করে ডাকনাম দিতেন।
সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর মাথায় বিরাট টাক দেখে কখনও ডাকতেন ‘বলডুইন’, কখনও ‘সুধাসমুদ্র’ আবার মাড়োয়ারীদের কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের অর্থসংগ্রহ করার জন্য কখনও ডাকতেন ‘সুধোরিয়া’। সচ্চিদানন্দ রায়কে* বলতেন ‘আলু’। কবির ভাষায় :
‘ওর একটা মজবুত রকম সংস্কৃত নাম ছিল, কিন্তু সে এখন আর কেউ জানে না। যেদিন শুনলুম ও পটোলের ভাই সেইদিন থেকে ও আলু। আজকাল আবার দেশী আলুতে কুলোচ্ছে না, তাই বলি পটেটো। আমার একদিকে বলডুইন, একদিকে পটেটোÑ জোরালো সব নাম।’
*সচ্চিদানন্দ রায় : কবির পার্সোনেল অ্যাটেন্ডেন্ট
 

তাপস রায়, সাংবাদিক ও লেখক  

Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam

Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon

SHOKHOBOR24.COM

2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201

TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA

COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition