শনিবারের কলমে হিমাদ্রী: মায়ের “শেখসাব”

প্রকাশঃ ২১-০৩-২০ ২:৪৩:৩১ পিএম
আপডেটঃ ২০২৪-০৫-০৫ ১:৫৫:৪২ পিএম
লেখকঃ হিমাদ্রী রয়
শনিবারের কলমে হিমাদ্রী: মায়ের “শেখসাব”
অনলাইন থেকে সংগৃহীত ছবি

ছেলে বেলায় আমার জন্মদিন নিয়ে কোন কৌতুল ছিল না। এ আর এমন কি। কাশবন, নবান্ন, শীতের পিঠা, রমজানি সাঁঝের ডালের বড়ার সাথে বড় হওয়া অনেকেরই জন্মদিন নিয়ে কৌতুহল ছিল না।

 

স্বজনেরা আমার মা কে জন্মদিনের কথা জিজ্ঞেস করলে, সঠিক তারিখ না বলে বলতেন সংগ্রাম থেকে নেমে। মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সংগ্রামটা কি মা?

 

মা বলেছিলেন সংগ্রাম মানে যুদ্ধ। সংগ্রাম মানে মুক্তি। 

 

ভাষার আগ্রাসন থেকে মুক্তি, সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে, মুক্তি দ্বীজাতিতত্ত্বের আগ্রাসন থেকে মুক্তি। আমার বাউল, আমার ভাটিয়ালি, আমার কীর্তন সব আমার থাকবে। 

 

‘ইস হারামজাদি কওম কি ম্যায় নসল বদল দুঙ্গি’ পাঞ্জাবির এই আস্ফালন কে দাবায়ে দিয়েছিলেন “শেখসাব”। আমার মা পাকিস্তানিদের পাঞ্জাবি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে “শেখসাব” বলতেন।


একাত্তরে পাকিস্থানি হায়েনার ভারি বুট আর গুলির মুহুর্মুহু আওয়াজে ভয়ের মিছিলে আমার মাও ছিলেন। আমি তাঁর গর্ভে নাড়ি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে আমার অস্তিত্ব কে একটু একটু করে বড় করে তুলছি, একটি স্বাধীন দেশে জন্মাবো বলে।

 

সীমান্তের ওপারে মুজিবনগর সরকারের অধীনে আহত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রে সেবা দিতেন বাবা। আতঙ্কের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে মা কখনো বালাট ক্যাম্পে, কখনো আত্মীয়ের আশ্রয়ে নয়মাস আমাকে জঠরে ধরে মা হওয়ার কিমত চুকিয়েছেন। 

 

প্রসব বেদনার সমস্ত ব্যাথা ভুলেছিলেন স্বাধীন দেশে আমার জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।

 

আমি বেড়ে উঠতে উঠতে মা এত গল্প করেছেন কিন্তু কখনই তাঁর প্রসব যন্ত্রনার কথা বলেন নি; কোন মাই তা বলেন না। কেননা সন্তানের নিষ্পাপ মুখ তার কাছে তাঁর আল্লাহ, তাঁর ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, অনুগ্রহ। তাই মায়েরা সমস্ত ব্যাথা ভুলে থাকেন কিন্তু ব্যাথাটা তাঁরা জানেন। যেমন আমরা ভুলে থাকি ছাব্বিশের আগে পঁচিশের কালো রাত ছিল সেই রাতে ইয়াহিয়া জল্লাদ, অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, নিরস্ত্র মানুষ কে হত্যা করেছে, গলা টিপে ধরেছে সভ্যতাকে।

 

ছাব্বিশ তারিখে মায়ের “শেখসাব”র আহবানে দামাল ছেলেদের গেরিলা প্রতিরোধ গড়ার আনন্দে জাতি ভুলে থাকে সেই রক্তাক্ত সময়ের কথা কিন্তু জাতি জানে রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া সেই কালো রাতের ব্যাথা।

 

মায়ের “শেখের বেটি”র সাহসী নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে উন্নয়নের চাকায় বাঁধা সময়ের ঘড়িটা রেলগাড়ির মত দ্রুত পার হয়ে এসেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।

 

আমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর “শেখসাব”র ভাস্কর্যের সামনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সমকার সেই বৃদ্ধার মত, এক বাটি দুধ, কটা পান আর চার আনা পয়সা রেখে বলতেন ‘খাও বাবা আর এই পয়সা কয়টা তুমি নেও আমারতো আর কিছু নাই’। তবে সেসময় হাজার হাজার জনতা পানের বাটায় নজরানা নিয়ে হাজির হতেন, মুসলিম লীগের বিপক্ষে, সাইকেলে চরা, টিনের চোঙা হাতে রাজনীতি করা, তরুণ শেখ মুজিবকে জিতিয়ে আনার জন্য। আজ তোমার রাজকোষের হরিলুট চলছে মহাসমারোহে। তোমার এই পয়সার দরকার পড়বে।

 

আমি আমার মায়ের বিশ্বাস কে ছুঁয়ে তাঁর “শেখসাব”র উচ্চতা মাপতে গিয়ে, গিরিশৃঙ্গের উপরে উঠে দেখি কোন আপনজনতো নাই তাঁর কাছে। তবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তর্জনী উঁচু করে, ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে রক্তাভ আকাশের নিচে। আমি তাঁকে দেখছি শীতকাতর মানুষ যেমন সূর্যকে দেখে। তিনি ব্যাসদেব রচিত মহানায়ক নন তিনি মুক্তিপ্রত্যাশী বাঙালির মহানায়ক। শুনুন পুরুষোত্তমের শঙ্খ বাজে ঐ    
‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং’।

 

জেগে উঠুন আবার গাণ্ডীব হাতে, বাঙালি শুনুক বজ্রকন্ঠের  সকল সাহসের স্পর্ধিত উচ্চারণ ‘এই দেশ না হিন্দুর, না মসুলমানের যে এই দেশকে নিজের বলে ভাববে এই দেশ তাদের’।

 

মা তোমার সেই “শেখসাব” যিনি মুক্তির কথা বলতেন, বাংলার মানুষর অধিকারের কথা বলতেন, সেই অধিকার আদায়ে যিনি ফাঁসির মঞ্চ কবুল করেছিলেন, তবে আজ মানুষের  অধিকার কে কেন আটকে দেয়া হয় ৫৭ ধারায়। 

 

মা তোমার “শেখসাব” বলতেন ‘বাংলার হিন্দু বাংলার মসুলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই আমার ভাই দেখবেন যেন আমার বদনাম না হয়’। তবে কেন ধর্মীয় গুজব পেট্রল, লাঠিসোটা আর দেশিয় অস্ত্র হয়ে হামলে পড়ে নিরস্ত্র সংখ্যালঘু মানুষের উপরে। রামো, নাসির নগর, গঙ্গাচড়া আর হালের শাল্লার নয়াগাঁও  আরো কত নাম জমা হলে শেখ সাবকে বদনাম করা হয়, তুমি বলতে পারো মা।
মা তোমার “শেখসাব” ৪৭’এ বলেছিলেন  ‘মাওরাদের সাথে থাকা যাইবো না এই পাকিস্তান বাঙালির অধিকার রক্ষা করবে না’। তবে তোমার শেখের বেটির স্বাধীন বাংলাদেশ কেন সকল মতের মানুষের মর্যাদার সহাবস্থানের অধিকার দিতে পারে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রস্ত থাকতে হয় হেফাজতের সন্ত্রাসের সামনে। তোমার “শেখসাব” কি তা জানে মা!

 

হিমাদ্রী রয়।  মার্চ/১৯,২১।
 

Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam

Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon

SHOKHOBOR24.COM

2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201

TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA

COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition