‘এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি কাঁদো/ জানি, দীর্ঘদিন কান্নার অধিকারহীন ছিলে তুমি/ হে ভাগ্যহত বাংলার মানুষ, আমি জানি/ একুশ বছর তুমি কাঁদতে পারোনি। আজ কাঁদো/ আজ প্রাণ ভরে কাঁদো, এসেছে কান্নার দিন/ দীর্ঘ দুই-দশকের জমানো শোকের ঋণ/ আজ শোধ করো অনন্ত ক্রন্দনে/’— এমনই পঙ্ক্তিমালা লিখেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো’ কবিতায়। বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিনটিকে নিয়েই এ কবিতা। একটি নামেই তাঁর পরিচয়। আর এই নামটিই হয়ে গিয়েছে ইতিহাস। বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামের। সেই ডাকে প্রাণ বাজি রেখেছিল বাংলার সাধারণ কিন্তু ভীষণ সাহসী সন্তানেরা। তাঁর স্বাধীনতার ডাক ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির নির্দেশে পাল্টে যায় পুরো দেশের চিত্র। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের জন্য বাংলায় বিদ্রোহ-সংগ্রামের তরঙ্গ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির প্রচণ্ড বিক্ষোভে একাত্তরের ৭ মার্চ রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। সেদিন প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু ডাক দেন স্বাধীনতার। এ আহ্বানে হতভম্ব হয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ভণ্ডুলের শেষ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হওয়ায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের নীলনকশা আঁটতে থাকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধৃর ভাষণের পর বাংলার দামাল ছেলেরা চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তার স্বপক্ষে দেশবাসী জেগে উঠতে শুরু করে। বাংলার দামাল ছেলেরা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হতে শুরু করে। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলতেই থাকে অসহযোগ আন্দোলন। এসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার না করায় প্রচণ্ড ক্ষোভ কাজ করছিল মানুষের মনে। যুদ্ধের ময়দানে নামার প্রচণ্ড তাড়নাও ছিল ছাত্র-যুবকের হৃদয়ে। সেই তাড়না থেকেই সেদিন সন্ধ্যাবেলায় শাহবাগে রেডিও অফিসে হামলা চালায় কয়েকজন তরুণ-যুবক। ৭ মার্চের ভাষণ এভাবেই তরুণ প্রজন্মকে ঘর থেকে টেনে এনেছিল। তরুণ-যুবক এবং বেতারকর্মীদের আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি বেতারে প্রচার করতে বাধ্য হয়। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় রেডিওতে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ প্রদেশের অন্যান্য বেতার কেন্দ্র থেকেও তা রিলে করা হয়। এদিকে ক্ষুব্ধ শিল্পীরা বেতার-টেলিভিশনে শর্ত দেন তারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন তবে সব অনুষ্ঠান আন্দোলনের অনুকূল হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিল্পীদের এই শর্ত মানতে বাধ্য হয়। এই ঐতিহাসিক ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত গোটা পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ৮ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাসহ সব শহর-গঞ্জ, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। এমনকি সরকারের পুলিশ বাহিনী ও ইপিআর বাঙালি সদস্যদের অনেকেই পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার প্রতি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, বাংলা ন্যাশনাল লীগের অলি আহাদ, পিডিবির নূরুল আমিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পূর্ণ সমর্থন দেয়। এদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। কেন্দ্রীয় কমিটির একই সভায় প্রতিটি জেলা শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং দেশের সব প্রেক্ষাগৃহে উর্দু ছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলন ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তারা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানান।
রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষিত নির্দেশের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। এতে বলা হয় ব্যাংকগুলো সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নগদ জমা, বেতন ও মজুরি প্রদান, এক হাজার টাকা পর্যন্ত প্রদান এবং আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স ও নগদ লেনদেন করতে পারবে। বিদ্যূৎ সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় বিভাগগুলো খোলা থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস, সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। পানি ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
তাজউদ্দীন আহমেদ আরেকটি পৃথক বিবৃতিতে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত প্রেসনোটের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, প্রেসনোটে হতাহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমিয়ে বলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বলে কথিত বক্তব্য সত্যের অপলাপ। নিজেদের অধিকারের স্বপক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীদের ওপরই নিশ্চিতভাবে গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করেছে বলে যে প্রচারণা করা হয়েছে তা বাঙালিদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। ৮ মার্চ ব্রিটেনে প্রায় ১০ হাজার প্রবাসী বাঙালি লন্ডনের পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামনে স্বাধীন বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
অন্যদিকে বাঙালির জাতীয় চেতনার একটি অবিস্মরণীয় দিন হচ্ছে একাত্তরের ১৯ মার্চ। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাত দিন আগেই বীরপ্রসবিনী জয়দেবপুরের মাটিতে শুরু হয় সংগ্রামী শ্রমিক-ছাত্র-জনতার প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে এই জয়দেবপুরেই (বর্তমান গাজীপুর) প্রথমে গর্জে ওঠে বাঙালির অস্ত্র। জয়দেবপুরের সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাহসী ভূমিকার কারণে সেদিন জয়দেবপুরের সর্বস্তরের জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। ১৯ মার্চের পর থেকে সারাদেশে শ্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ এ ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ ২৩ মার্চ ১৯৭১ পালন করে বাংলাদেশ দিবস হিসেবে। দিনটিকে পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালনের কথা থাকলেও সেদিন তা হয়নি। এদিকে সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়েছিল। দু’একটি জায়গা ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা যায়নি। আর এই দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সূর্যোদয়ের পর তাঁর বাসভবনে (ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোড) স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং বক্তৃতা করেন।
এরপর নির্মাণ হয় অনন্য ইতিহাস। রক্ত, অশ্রু ও সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৭১ সালে প্রিয় স্বদেশকে আমরা পাই স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে। বাঙালির অমিত বিক্রম, অযুত শহীদের আত্মত্যাগ আর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসীম সাহসী নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এবার পা দিলো স্বাধীনতার ৪৮ বছরে। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় পাঁচ দশক খুব বেশি সময় না হলেও একটি দেশের গঠন ও বিকাশে কম সময়ও নয়। আর একটি দশক পর আমরা পৌঁছে যাব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পৌঁছে দেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমাদের অর্জন, সংকট ও সম্ভাবনা আমরা খুঁজে দেখতে চেয়েছি; আর চেয়েছি এ অনুসন্ধান হোক তারুণ্যের চোখে। সেই তারুণ্য, যাদের প্রত্যেকের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে, জন্মেই যারা পেয়েছে স্বাধীনতার আস্বাদ, পরাধীনতার শৃঙ্খল বিষয়ে যারা অনভিজ্ঞ এবং যারা দেখেনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি শোষণ সম্পর্কে যাদের প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই। প্রিয় বাংলাদেশ— যার সমৃদ্ধি আমাদের গৌরবান্বিত করে, যার ব্যর্থতা আমাদের বিদীর্ণ করে, সেই বাংলাদেশকে আরও বর্ণিল, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে আজকের তারুণ্যের অপার সম্ভাবনাই যে সবচেয়ে বড় শক্তি তা আমরা বিশ্বাস করি। পূর্ব প্রজন্মের গৌরব ও কীর্তি পরবর্তী প্রজন্মের স্পর্ধিত হাতে এগিয়ে যায় সামনে— এটিই সমাজ প্রগতির শিক্ষা। আগামী দিনের বাংলাদেশ সব প্রজন্মের সম্মিলিত অংশগ্রহণে নিজের পায়ে সর্বময় মর্যাদায় বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে— এই বিশ্বাস অতিশয়োক্তি নয়।
একাত্তর আমাদের অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের কাছে কেবল শোনা গল্প। মা, বাবার কিংবা যুদ্ধে অংশ নেওয়া স্বজনের স্মৃতিগল্প। সেদিন আমাদের জন্ম হয়নি। দেখিনি স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো। শুনিনি সেদিন কবির কণ্ঠে সেই কবিতাখানি, অবাক হইনি তাঁর দৃপ্ত স্বাভাবিক পথচলায়। ভাবতেও পারি না, মাত্র একজন লোক কী করে কোটি কোটি বাঙালিকে মোহিত করেছিলেন। হোক না তা আমাদের কাছে অন্যের মুখে শোনা গল্প। তবু তো বাস্তব। তাই উপলব্ধি করি কেবল একজন শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলেন সারা দেশের তরুণ-যুবাদের। নাড়া দিয়েছিলেন পুরো বাংলাকে। কিন্তু কতটুকু জানি আমরা তাঁর কথা, কিংবা তাঁর ভূমিকাকে কতটা স্মরণ করি? এই প্রজন্মের কাছে তিনি কি কেবল একটি নাম শেখ মুজিবুর রহমান, নাকি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু অথবা স্বাধীনতার প্রতিশব্দ হয়ে আছেন? আমি মনে করি, তিনিই এই দেশের জন্মদাতা। তাঁর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আর বাংলাদেশের জন্ম না হলে আমি আজ তাঁকে নিয়ে কথা বলতে পারতাম না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তাঁকে নিয়েই যখন বিতর্র্ক হয়, তখন লজ্জায় মরে যাই। ভাবি, তিনি কি দূর পরবাসে থেকে হাসছেন আর বলছেন— ‘এই জন্য তো আমি যুদ্ধের ডাক দিইনি।’
বঙ্গবন্ধু যে ময়দান থেকে ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন, উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ পেতে এবং যে ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, সেটি তৎকালীন রেসকোর্স এবং আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে প্রতিদিনই সন্ধ্যায় জমে তরুণের মেলা। সেখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। তাদের কথা, ‘বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ভালো মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন যে কারও আদর্শ হওয়ার মতো। অনেক দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আমাদের জন্য। এই প্রজন্মের আমরা যখন এখনকার রাজনীতিবিদদের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরতে চাই, তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমাদের তাঁর দেখানো পথে চলতে উৎসাহ জাগায়।’ একজনের মতে, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য যা করেছেন, কিংবা তাঁর অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করার নয়। আমি যে তাঁর দেশে জন্ম নিয়েছি, এটাই আমার জন্য গর্বের বিষয়।’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের এই ভাবনা থেকে যে কথা বেরিয়ে আসে, তা হলো মৃত্যুর পরেও দেশের প্রতিষ্ঠাতা এই দেশ থেকে হারিয়ে যাননি, যেতে পারেন না। তিনি চিরঞ্জীব।
স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর এবার। বাঙালির হাজার বছরের জীবন কাঁপানো ইতিহাস মহান স্বাধীনতা। যা আমাদের ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় অর্জন। বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার শক্তি আর বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনাকে লালন করে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। স্বদেশবিরোধী কুচক্রী মহলের কর্মকাণ্ড, দলতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ও সোনার বাংলা গড়ায় বড় ধরনের বাধা। ৪৮ বছরে আমাদের যতটুকু এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল তা হয়নি, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে যে রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তা আমাদের উন্নয়নের পথকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
স্বাধীনতার যে চেতনা ছিল, এই ৪৮ বছরের বেশি সময় তা রাষ্ট্রের কাজের ভিতর প্রতিফলিত হয়নি। যার ফলে রাষ্ট্রের যে বিকাশ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি।
ইতিহাসবিদরা দেশের জন্য স্বপ্ন দেখেন না। দেশের জন্য স্বপ্ন দেখেন রাজনীতিবিদগণ। এ স্বপ্নে আর্দশ থাকে, দর্শন থাকে। এ রকম স্বপ্ন যাঁরা দেখেন তাঁরাই স্বাপ্নিক। সেই স্বাপ্নিক রাজনীতিবিদগণই ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ইতিহাসবিদরা ইতিহাস সৃষ্টি করেন না, তারা কেবল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন ও বিশ্লেষণ করেন। তাই আজকের প্রজন্মকে জানতে হবে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে। তাঁর আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর মতো করে ভালোবাসতে হবে স্বদেশকে। অন্যদিকে আর মাত্র দুই বছর অতিক্রান্ত হলেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। আবার এর মধ্যে আমরা ক্রমশ হারাতে থাকবো একাত্তরের আগের বীর সংগ্রামী সন্তান ও একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। ইতোমধ্যে অনেক বীর সেনানীদের হারাতে হয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশে একাত্তরের পরে জন্ম নেওয়া নাগরিকই বেশি, যাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা নেই। ধীরে ধীরে এ জাতিকে আন্দোলন-সংগ্রামের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতা আন্দোলনে-সংগ্রামের অকুতোভয় বীর সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা জীবিত রয়েছেন, তাদের সান্নিধ্যে বেশি বেশি করে আসতে হবে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বহু বছর নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার ভুলপাঠ হাজির করা হয়েছে। সেদিকে নজর রেখে বাংলাদেশের শেকড়ের সন্ধান করে জানতে হবে স্বাধীনতার ইতিহাসের ইতিকথা ও বিস্তারিত পটভূমি। জানতে হবে তাদের কথা, যাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ফল হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে একদিন জয়যুক্ত হয়েছিল লাল-সবুজের পতাকা।
অঞ্জন আচার্য, কবি ও গল্পকার
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition