“অর্ধেক লেখক কাজী দার ছাত্র হওয়ার যোগ্য নন”

প্রকাশঃ ২০-০৬-১৫ ৩:২০:৩৩ পিএম
আপডেটঃ ২০২৪-১২-০৩ ১২:২৪:৪৬ পিএম
লেখকঃ সুমন্ত আসলাম
“অর্ধেক লেখক কাজী দার ছাত্র হওয়ার যোগ্য নন”
কাজী আনোয়ার হোসেন

দু বার দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে---একবার একটা লেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে, দ্বিতীয়বার একটা লেখা চাইতে গিয়ে। দু’বারই কাজী আনোয়ার হোসেনকে সর্বোচ্চ মোহনীয় মনে হয়েছে আমার, অপরিসীম ভদ্র, সর্বোপরি শ্রদ্ধাজাগানিয়া অবয়বময়।
সবে ঢাকা এসেছি। ‘কিশোর পত্রিকা’ নামে কিশোরদের জন্য একটা বই আকারের পত্রিকা বের হতো সেবা প্রকাশনী থেকে। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন লেখক টিপু কিবরিয়া। একদিন সেগুনবাগিচায় সেবা প্রকাশনীর অফিসে গিয়ে একটা গল্প দিলাম তাঁর হাতে---ভূতবন্ধু। তিন সপ্তাহ পর টিপু কিবরিয়া জানালেন, কাজী দা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবেন। কেঁপে ওঠে বুকের ভেতর।
কাজী দা ওই গল্পটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন, খানিকটা পরিবর্তন করে দ্বিতীয়বার লিখে দিলাম। ছাপা হলো পরেরবার।
‘আলপিন’ ঈদ সংখ্যা হবে সেবার ডাবল সাইজে---৩২ পৃষ্ঠার, চার রঙের। কাজী দার একটা লেখা দরকার। দ্বিতীয়বারের মতো দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি লেখা দিলেন খুব আন্তরিকতায়। অনেকক্ষণ আলাপ হলো। সব শেষে বললেন, ‘আপনার সমন্ধে জানি, লিখবেন নাকি সেবাতে?’ তখন খানিকটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছি বইমেলাতে। ‘একটু ভাবি?’ বলে চলে এসেছিলাম।
তারপর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার।

 

বুকে হাত দিয়ে বলছি---সেবা প্রকাশনীর বই পড়ে বড় হয়েছি আমি, আমার মতো অনেকে। বাংলাদেশে শুধু না, বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন লেখক অতি অতি অতি চমৎকার, মুগ্ধকর, সাধু বাক্য লেখেন, তাদের মধ্যে কাজী দা একজন। তাঁর ‘পঞ্চরোমাঞ্চ’, ‘ছয়রোমাঞ্চ’, গল্পের বইগুলো যারা পড়েছেন, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন তা। গল্পগুলো অনুবাদ, কিন্তু আক্ষরিক অনুবাদ নয়। ছায়া নিয়ে নিজের মতো করে লেখা। প্রতিটি গল্পে চমৎকারিত্ব লেখনি, লেখার ঢং, কারিশমা, স্তম্ভিত করেছে পাঠককে।
এরিক মারিয়া রেমার্ক, অ্যালিস্টিয়ার ম্যাকলিন, হ্যানরি শ্যারিয়ার, জুল ভার্ন প্রমুখ লেখকের বইয়েরে অনুবাদ আমি অন্য প্রকাশনীরও পড়েছি, কিন্তু সেবা প্রকাশনীর মতো এতো ঝরঝরে, প্রাণকাড়া অনুবাদের বই আমি কখনো পড়িনি। বিশ্ব সাহিত্যের বড় বড় বইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেবা প্রকাশনী তথা কাজী আনোয়ার হোসেন। সেখান থেকে আমরা শিখেছি, জেনেছি, বিশ্ব সাহিত্যে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি। তখন এরকম ইন্টারনেট ছিল না, ছিল না ওইসব বই হাতে পাওয়ার সহজলভ্যতাও।

 

আমাদের দেশ হচ্ছে ‘পুরষ্কার’-এর দেশ। এখানে যিনি পুরষ্কার পান, তিনি ধন্য হন না; যিনি বা যারা দেন, তারা ধন্য হন। তাই তো দেশের প্রকৃতজনরা কম পুরস্কার পান এখানে, যারা পান তাদের কাছে সেই পুরষ্কারের কোনো মূল্য থাকে না, প্রচুর পেতে পেতে এক ধরনের অবজ্ঞা এসে যায় সেই পদকে, কেবল শোকেসের একটা তাক দখল করে ওটা, ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ঢেকে থাকে সারাবছর।
কাজী আনোয়ার হোসেন কি কোনো পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য নন?

আমি জোর গলায় বলতে পারি, চিৎকার করে বলতে পারি---বাংলা একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত যারা পুরষ্কার পেয়েছেন, তার অর্ধেক লেখক কাজী দার ছাত্র হওয়ার যোগ্য নন, তার সমতূল্য লেখালেখি তো দূরের কথা!
অথচ প্রতিবছর কতভাবে, কত কৌশলে, কত কায়দা করে একেকজনকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, পুরস্কৃত করা হচ্ছে, সেখানে কাজী আনোয়ার হোসেন নেই! আর কিছুতে না হোক, কেবল লেখক সৃষ্টি আর বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক আগেই অনেকগুলো পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল তার। যদিও তিনি মস্ত বড় একজন লেখক।
কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস!

তাকে পুরস্কার না দিয়ে তাকে আমরা নিচু করিনি, বরং নিজেরাই নিচু হয়েছি। তাই তো প্রতিবছর একেকটা পুরস্কারের খবর জানার পর হাসাহাসি পড়ে যায় চারদিকে।

 

‘যে দেশে জ্ঞানীর কদর নেই, সে দেশে জ্ঞানী জন্মায় না।’ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক আগে বলে গেছেন কথাটা। ‘প্রকৃত মানুষ’রাই ‘প্রকৃত জ্ঞানী’দের চিনতে পারেন, মর্যাদা দেন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিবছর নেতা জন্মায়, মন্ত্রী জন্মায়, বড় বড় পদ দখল করার জন্য অযোগ্য আর নির্লজ্জ মানুষ জন্মায়। কারণ তাদের শত কুকীর্তি জেনেও আমরা তাদের ভয় পাই, কপালের সঙ্গে হাতের চেটো ঠেকিয়ে পদলেহনময় সালাম দেই।

আমরা তাদের পায়ের কাছে বসে থাকতে পছন্দ করি বলে তারা আমাদের ঘাড়ে পা রাখেন, মাথায় পা রাখেন, তারপর সেখানে চাপ দিয়ে আমাদের ছেড়ে উড়াল দেন আকাশে।
আমাদের আর ‘প্রকৃত মানুষ’ হয়ে ওঠা হয় না, আমাদের আর ‘প্রকৃত জ্ঞানী’র দেখা মেলে না।

 

সুমন্ত আসলাম, লেখক ও সাংবাদিক।

Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam

Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon

SHOKHOBOR24.COM

2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201

TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA

COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition