করোনাভাইরাসকে যেভাবে জয় করল ভিয়েতনাম

প্রকাশঃ ২০-০৫-৩০ ৩:২৯:২২ পিএম
আপডেটঃ ২০২৪-১২-০৩ ১২:২১:১৪ পিএম
লেখকঃ সুখবর ডেস্ক
করোনাভাইরাসকে যেভাবে জয় করল ভিয়েতনাম
অনলাইন থেকে সংগৃহীত ছবি

৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দেশ ভিয়েতনাম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও  তথ্যসূত্র মতে শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি! পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ৩২৭ জন এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে আবার ২৭৯ জন সেরে উঠেছেন।

সারা পৃথিবীর ধনী ও উন্নত দেশগুলো যেখানে কোভিড-১৯ এর মহামারিতে পর্যুদুস্থ সেখানে ভিয়েতনাম কোন জাদুমন্ত্র বলে এই মহামারির বিরুদ্ধে সফল। 

জানা গেছে, দেশটিতে মাত্র তিন সপ্তাহের লকডাউন ছিল। এর পর এপ্রিলের শেষে সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। দেশটিতে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ হয়নি ৪০ দিনের বেশি সময়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার চালু হয়েছে। জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।

 

সংশয়বাদীরা হয়ত ভিয়েতনামের এই সরকারি সংখ্যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় দেশটির প্রধান একটি হাসপাতালে কর্মরত সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসক গাই থোয়াইটস মনে করছেন, এই সংখ্যা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

হো চি মিন সিটিতে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ইউনিটেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই চিকিৎসক সম্প্রতি সিএনএনকে বলেন, “আমি প্রতিদিন ওয়ার্ডগুলোতে যাই, আমি জানি সেখানে মৃত্যুর কোনো ঘটনা নেই।”

তিনি জানান, শহরে বাসিন্দাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়লে তো হাসপাতালে রোগীরা আসতোই। কিন্তু এমনটা কখনও ঘটেনি।

তাহলে কীভাবে ভিয়েতনাম বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে ব্যাপকভাবে করোনভাইরাসের মহামারী থেকে বেঁচে গেল?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারীর বিস্তার রোধে সরকারের শুরুতেই দ্রুত পদক্ষেপ থেকে শুরু করে ব্যাপকভাবে কন্টাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেন্টিন করা এবং জনগণের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের মধ্যে এর উত্তর মিলবে।

 

দ্রুত পদক্ষেপ

দেশটিতে প্রথম কেউ আক্রান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই ভিয়েতনাম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনও ‘সুস্পষ্ট প্রমাণ’ মেলেনি বলে তখনও চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জোর দিয়ে বলে আসছিল। কিন্তু ভিয়েতনাম কোনো ঝুঁকি নেয়নি।

হ্যানয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইজিন ও এপিডেমিওলজির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-প্রধান ফ্যাম কোয়াং থাই বলেন, “কেবল ডব্লিউএইচওর দিকনির্দেশনার জন্য আমরা বসে থাকিনি। আগেভাগে পদক্ষেপ নিতে দেশের ভেতরে-বাইরে থেকে আমরা উপাত্ত সংগ্রহ করেছি।”

 

জানুয়ারির শুরুতেই হ্যানয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনের উহানফেরত যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। জ্বর থাকলে যাত্রীদের বিচ্ছিন্ন রেখে তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে বলে তখন দেশটির জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে বলা হয়।

জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী ভু ডাক ডাম ভিয়েতনামে প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া রোধে স্থল বন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলিতে মেডিকেল কোয়ারেন্টিন জোরদার করতে ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিতে সরকারি সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দেন।

ভিয়েতনামে ২৩ জানুয়ারি প্রথম দুজনের করোনভাইরাস শনাক্ত হয়। এরা ভিয়েতনামে বসবাসরত এক চীনা নাগরিক ও তার বাবা, যিনি উহান থেকে এসেছিলেন। এরপর উহানের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় ভিয়েতনাম।

ভিয়েতনামের বাসিন্দরা যখন চান্দ্র নববর্ষের ছুটি উদযাপন করছিল তখন ২৭ জানুয়ারি ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির এক জরুরি সভায় করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের’ ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী নুয়েন সুয়ান ফুক। প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে তিন দিন পর গঠন করেন জাতীয় নির্বাহী কমিটি। সেদিনই করোনাভাইরাসকে বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হিসেবে ঘোষণা করে ডব্লিউএইচও।

১ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে ‘জাতীয় মহামারী’ ঘোষণা করে ভিয়েতনাম, যখন দেশটিতে মাত্র ছয় জন আক্রান্ত ছিল। চীনের সঙ্গে সব ফ্লাইট বন্ধ করে ভিয়েতনাম। পর দিন চীনাদের ভিসা দেওয়াও স্থগিত করে দেশটি।

এরপর একে একে দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালির মতো দেশের ক্ষেত্রেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, আগমণে কোয়ারেন্টিন ও ভিসা স্থগিত করা হয়। আর মার্চের শেষের দিকে সব বিদেশিদের প্রবেশ স্থগিত করা হয়।

কার্যকর লকডাউন ব্যবস্থাও শুরুতেই নিয়েছিল ভিয়েতনাম। সাত জন ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ১২ ফেব্রুয়ারি হ্যানয়ের উত্তরে ১০ হাজার বাসিন্দার পুরো একটি গ্রামাঞ্চল ২০ দিনের জন্য লকডাউন করে রাখা হয়- যেটা ছিল চীনের বাইরে প্রথম বড় আকারের লকডাউন।

নববর্ষের ছুটির পরে ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় চালু হতে যাওয়া স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মে মাস পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

হো চি মিন সিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ থোয়াইটস জানান, ভিয়েতনামের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই সাফল্যের মূল কারণ।

 

নির্ভুল কন্টাক্ট ট্রেসিং

শুরুতেই নেওয়া কড়া পদক্ষেপ গণসংক্রমণ কার্যকরভাবে রোধ করায় ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভিয়েতনামে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১৬ জনে থাকে। ভিয়েতনামের নাগরিকরা বিদেশ থেকে ফিরতে শুরু করার পর মার্চ মাসে দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরুর আগ পর্যন্ত তিন সপ্তাহে দেশটিতে নতুন কেউ আক্রান্ত হয়নি। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের গতিবিধির কড়া নজরদারির মধ্য দিয়ে তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।

ডাক্তার ফ্যাম বলেন, “আমাদের ৬৩টি প্রাদেশিক ও ৭০০টিরও বেশি জেলা পর্যায়ের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) এবং ১১ হাজারের বেশি কমিউনিটি হেলথ সেন্টার রয়েছে, যার সবাই কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে ভূমিকা রাখে।”

তিনি জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্তকে আগের ১৪ দিনে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ একটি তালিকা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি কোথায় ও কখন গিয়েছিলেন তা পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশনে ঘোষণা করে জনগণকে জানানো হয়। কেউ একই সময়ে সেসব জায়গায় গিয়ে থাকলে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পরীক্ষার জন্য যেতে আহ্বান জানানো হয়।

ফ্যাম বলেন, মার্চ মাসে ভিয়েতনামের অন্যতম বড় হ্যানয়ের বাখ মাই হাসপাতাল যখন কয়েক ডজন রোগী নিয়ে করোনাভাইরাসের হটস্পট হয়ে উঠলে সেটা লকডাউন করা হয়। চিকিৎসক, রোগী, দর্শনার্থী ও তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন – সব মিলিয়ে এক লাখ মানুষকে খুঁজে বের করা হয়।

“কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আমরা প্রায় সবাইকে খুঁজে পেয়েছি। তাদেরকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলেছি। কোনও লক্ষণ দেখা দিলে তাদেরকে বিনামূল্যে পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে বলেছি।”

হাসপাতালটির একহাজার স্বাস্থ্যকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ১৫ হাজারের বেশি মানুষের পরীক্ষা করেছে কর্তৃপক্ষ। ভিয়েতনামের কন্টাক্ট ট্রেসিং এতোই পুঙ্খানুপুঙ্খ ছিল যে কেবল সংক্রমিত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ নয়, পরোক্ষভাবে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও খুঁজে বের করা হয়।

আক্রান্তদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা সবাইকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হোটেল বা সেনাশিবিরে সরকারি কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। আর পরোক্ষভাবে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নিজেদের ঘরে বিচ্ছিন্ন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় বলে ভিয়েতনামের কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে দেশটির প্রায় ২০ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের করা গবেষণায় বলা হয়।

গবেষণা অনুযায়ী, ১ মে পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার মানুষকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়, আর এক লাখ ৪০ মানুষকে বাড়িতে বা হোটেলে আইসোলেশনে রাখা হয়।

ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের প্রথম ২৭০ জন কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে ৪৩ শতাংশের কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি, যা পুঙ্খানুপুঙ্খ কন্টাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেনটাইনের গুরুত্ব তুলে ধরে। কর্তৃপক্ষ সংক্রমণ বিস্তারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের এভাবে সক্রিয়ভাবে খুঁজে না বের করলে তারা শনাক্ত হওয়ার অনেক আগেই নীরবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিত।


জনসংযোগ ও প্রচার

ভিয়েতনাম সরকার শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে জনসাধারণকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে। মহামারী ও চিকিৎসা পরামর্শ বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জনগণকে জানাতে নিবেদিত ওয়েবসাইট, টেলিফোন হটলাইন ও মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়। এসএমএস বার্তার মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও নিয়মিতভাবে নাগরিকদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠায়।

ফ্যাম বলেন, একটি ব্যস্ত দিনে কেবল জাতীয় হটলাইনগুলি ২০ হাজার কল নিতে পারত। এর বাইরেও কয়েকশ প্রাদেশিক ও জেলা পর্যায়ের হটলাইনতো ছিলই।

কাজে লাগানো হয় দেশটির প্রচারের মাধ্যমগুলোকেও। লাউডস্পিকার, পোস্টার, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে এই মহামারী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো হয়।

সঠিকভাবে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে জনপ্রিয় একটি ভিয়েতনামি পপ হিটের সুরে আকর্ষণীয় মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ‘হাত-ধোয়ার গান’ হিসাবে পরিচিত ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়, যেটা ইউটিউবে ৪ কোটি ৮০ লাখ বারের বেশি দেখা হয়েছে।

থোয়াইটস বলেন, ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সার্স মহামারী ও পরে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় ভিয়েতনামের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা সরকার ও জনগণকে কোভিড-১৯ মহামারী রোধে প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করেছে।

Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam

Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon

SHOKHOBOR24.COM

2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201

TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA

COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition