নন্দিত তারকা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শামীম শাহেদ। সম্প্রতি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা খুবই সময়োপযোগী। সঙ্গত কারণে স্ট্যাটাসটি সুখবরের পাঠকদের জন্যে হুবহু তুলে ধরা হল।
আমি দেখলাম ‘কোভিড-১৯’ যাকে আমরা ‘করোনা’ বলে ডাকি সে আসলে বেশ সম্ভ্রান্ত গোছের, খুব আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একটি ভাইরাস! যারা করোনাকে গুরুত্ব কম দিয়েছে বা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাদেরকেই সে গলা টিপে ধরেছে। সেদিন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এ দাঁড়িয়েই একজন বলছিল, ‘কি যে বলেন ভাই, করোনা-ফরোনা কিচ্ছু না। গত বিশ বছর এইখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিয়েছি, সামনে আরও বিশ বছর দিব।’
পরের সপ্তাহেই শুনি তিনি-পজিটিভ। করোনার চুম্বনে আহত।
আবার কেউ কেউ শুরু থেকেই ছিল বেশ সিরিয়াস। নাকে-মুখে মাস্ক, হাতে গøভস, পকেটে সেনিটাইজার। তারা কিন্তু এখনো তবিয়তেই বহাল। তাই আমি এই রচনার শুরুতেই কোভিড-১৯ এর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কোথাও কোনো বেয়াদবি হয়ে থাকলে নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। এই লেখার কোনো চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কারো কোনো মিল নাই। কোথাও কোনো মিল খুঁজে পেলে সেটা নিতান্ত কাকতাল মাত্র।
প্রথম প্রথম যখন চীন দেশ থেকে করোনার খবর আসতে লাগল তখন কেউ-ই তেমন একটা গা করেনি। যখন একটা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল, একজন দাঁড়ানো মানুষ ধপাশ করে মাটিতে পড়ে গেছে তখনই করোনা প্রথম আমাদের হৃদয়ে আঘাত হানল। তারপর মাস খানেক এর মধ্যে হৃদয় থেকে শরীরে নেমে এলো। এখন করোনা নিয়ে বেশ রসিকতাও দেখা যাচ্ছে।
এখন ফেইসবুক খুললেই দেখা যায় নানারকম স্টেটাস। একজন অনেকটা নিউজের মতো করে লিখেছেন, কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে ছবি তুলতে গিয়ে সাংবাদিক নিজেই চৌদ্দ দিনের কোয়ারেন্টিনে।
আরেক জন লিখেছেন, ‘বিদেশ ফেরত স্বামী ঠাঁই পেলেন না শশুরবাড়িতে।’
‘মাস্ক নাকি মাক্স-এই নিয়ে সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত।’
আরেক প্রেমিক প্রেমিকা বিশ মিনিট চুমু খাওয়ার পর একজন আরেকজনকে বলছে, ‘এত কাছে এসো না। করোনার ভয় আছে। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখো। ছয় ফিট দূরে বসো।’ এর প্রতিবাদে প্রেমিক তিন-চারটা হাঁচি উপহার দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে।
আরেক স্টেটাসে দেখলাম, করোনার টিকা বিক্রির অপরাধে তিন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সবচেয়ে নির্মম ছিল, ইতালি থেকে স্বামী আসছে শুনে স্ত্রী পলাতক।
আরেকজন লিখেছেন, ‘মাস্ক পরা অবস্থায় নিজের শশুরকে চিনতে না পেরে সিগারেটের আগুন চেয়ে অপমানিত মেয়ের জামাই এর আত্মহত্যা।’
পরের স্টেটাসটা আরও ক্রিয়েটিভ, ‘ফকির বাবার পরামর্শে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে থানকুনি পাতা ভেবে গাঁজা পাতা খেয়ে ফেলেছেন শাশুড়ী আর পুত্রবধূ। তারপর তিন দিন বেহুশ।’
এইরকম স্টেটাসের বন্যা দেখেছিলাম পর পর তিন দিন ভূমিকম্প হওয়ার সময়। কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশে পরপর কয়েক দিন বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প হল। ফিল্মের এক নায়িকা তার স্টেটাসে লিখলেন, ’এখন ঘুমানোর আগে প্রতিদিন জিন্স-টিশার্ট পরে ঘুমাই, সঙ্গে হালকা মেকআপও নিয়ে রাখি। বলাতো যায় না কখন ভ‚মিকম্প হয়, কখন বিল্ডিংয়ের নিচে চাপা পড়ি। দমকল বাহিনীর লোকজন এসে কীভাবে না কীভাবে উদ্ধার করে। জিন্স-টিশার্ট পরা থাকলে সেইফ। নায়িকা বলে কথা।’
ভূমিকম্প নিয়ে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন আরেক তরুণী। তিনি লিখেছেন, ‘বেশ কিছুদিন থেকেই দেখি মাথা ঘুরছে। মাঝে মাঝে বমি-বমি লাগছে। খুব চিন্তায় ছিলাম। একজন বললেন, ভূমিকম্প। যাক এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।’
করোনার ট্রিটমেন্ট নিয়েও চলছে খেলা। কেউ বলে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন খাও, কেউ বলে খেও না। কেউ বলে করোনার জন্য ম্যালিরিয়ার আগের ঔষধ টা-ই ভালো হবে। কেউ বলে, ‘না, না, মারা যাবা।’ কেউ বলে অ্যালকোহল দিয়ে হাত পরিস্কার করলে যদি হয় তাহলে ফুসফুস টা একবার বের করে পরিস্কার করে দিলে কেমন হয়? আবার কেউ বলে সেনিটাইজার যেহেতু করোনার জীবানু মারে তাহলে প্রতিদিন একটু করে সেনিটাইজার খেলে নিশ্চয়ই আমাদের ভেতরের করোনা জীবানুগুলোও মারা যাবে। অবাক কান্ড। একটা জোক মনে পড়ে গেল।
একবার এক তরুণী দৌড়ে ডাক্তারের কাছে এলেন, ডাক্তার সাহেব আমার বা-পা নীল হয়ে যাচ্ছে।
ডাক্তার সাহেব খুব সিরিয়াস। বললেন, ‘কোথায়? দেখি দেখি।’ একটু পর্যবেক্ষণ করেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও মাই গড। পুরো পা নীল হয়ে গেছে। এখনই কেটে আলাদা করতে হবে।’
জরুরি ভিত্তিতে পা কেটে ফেলা হল। কিছুদিন পর সেই তরুনী খোড়াতে খোড়াতে আবার এলেন, ডাক্তার সাহেব এবার আমার ডান পা নীল হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার সাহেব এবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, আসলে আপনার জিন্স পেন্ট থেকে রং যাচ্ছে।
একবার আমি ব্যাংকক গেলাম ফিজিক্যাল চেকআপ করতে। সব টেষ্ট করার পর দেখা গেল প্রায় সব রেজাল্টই পজিটিভ আসছে। শুধু এইচআইভি নেগেটিভ। এখন অবশ্য ‘পজিটিভ’ শব্দটা শুনলেই ভয় লাগে। চারদিকেই শুনি এর করোনা পজিটিভ, ওর করোনা পজিটিভ। করোনা সব কিছু উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে। শুনেছি করোনাকালে অন্য ভাইরাসগুলো নাকি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কেউ তাদেরকে দাম দিতে চাচ্ছে না।
আমি অবশ্য করোনার অনেক নেগেটিভ এর পাশাপাশি অনেক পজিটিভ দিকও দেখতে পাচ্ছি। করোনার কারনে মানুষে মানুষে ভালোবাসা বেড়েছে। করোনার কারনে এক দিনের জন্য হলেও যুদ্ধ থেমেছে। পরিবারকে বেশি করে সময় দেওয়া যাচ্ছে। অনেক সুপ্ত প্রতিভার প্রকাশ ঘটছে। পৃথিবীও নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় পেয়েছে। নদীর পানি ফ্রেস হয়ে গেছে, আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে, বাতাসে অক্সিজেন বেড়ে গেছে। নানাবিধ ঘটনা।
মানুষে মানুষে ভালোবাসাটা বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে এই করোনার কারনেই। আমাদের শিল্পীদের মধ্যে এই গুণটা অবশ্য সব সময়ই দেখা যায়। যেকোনো বিপদ আপদে তারা পাশে এসে দাঁড়ায়। সম্প্রতি দেখা গেছে, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের পর্দার পিছনের মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশের শিল্পীদের পাশাপাশি প্রবাসী শিল্পীরাও। এর মধ্যে আছেন টনি ডায়েস, রিচি, শ্রাবন্তী, মাসুম রেজা, শামসুল আলম বকুল, এস এ হক অলীক, ফরহাদ হোসেন, এ আই রাজু, সুইটি, তারিন, শহিদুজ্জামান সেলিম, মুহিন খান, সালাউদ্দীন লাভলু, অপি করিম, বন্যা মীর্জা, অনিমেষ, ভাবনা, পুতুল, খাইরুল ইসলাম পাখি, হিল্লোল, নওশীন, শাহ মাহবুব, ফারিয়া হোসেন, নাদিয়া, প্রিয়া, শশি, বিজরী, দীপা, রওনক, সুমনা সোমা, ঝিলিক, লুৎফুন নাহার লতা, কাজী উৎপল, তমালিকা, চন্দ্রা, শামীম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে।
পর্দার তারকাদের পাশাপশি নিস্বার্থ ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন আরও অনেকে। ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের কাছে তো আমাদের কৃতজ্ঞতারই শেষ নাই। এই সময়ের তারকা মূলত তারাই। স্যালুট আপনাদের। করোনার প্রকোপ না বাড়লে হয়তো অনেকের ভালোবাসার কথা অজানইা থেকে যেত।
এরমধ্যে যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন তাদের বুক ভাঙ্গা কষ্টটা হয়তো আমরা আঁচ-ই করতে পারব না। তাদের জন্য সমবেদনা। সম্ভবত জীবনের সবচাইতে করুণ স্টেটাসটা আমি কদিন আগেই দেখেছি। কবরের জন্য একজন একটা স্টেটাস দিয়েছেন। ‘করোনা আক্রান্ত কারো জন্য কবর প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। আমরা কবরের খোঁজ দিয়ে থাকি। ধন্যবাদান্তে, লং আইলেন্ড ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল পার্ক।’ নিউইয়র্কের মতো জায়গায় প্রতিদিন এত এত মানুষ মারা গেছে যে, এক সময় মৃতদেহ রাখার জন্য হাসপাতালের বাইরে রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমান মর্গ বসানো হয়েছিল। কত কিছু দেখতে হল। যদি এ যাত্রায় বেঁচে যাই তাহলে হয়তো একদিন আমাদের স্বাক্ষাৎকার নেবে ভবিষ্যৎের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। কেমন দেখেছেন করোনা বিস্তার।
আমাদের এক বন্ধু আছেন শহীদ লস্কর ভাই। তিনি ভয়ঙ্কর কষ্টের মধ্যেও হাসি খুঁজে বের করতে পারেন। একদিন তিনি খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, করোনা আমাদের দেহটা পেলেও মন কিন্তু পাবে না।
- কেন বলেন তো?
- করোনার আগ্রহ ফুসফুসের দিকে হার্টের দিকে না।
আরেকটি গল্প মনে পড়ে গেল। আগে সিনেমার নায়িকারা ভিলেইনদের কী বলত? ছেড়ে দে সয়তান, তুই আমার দেহ পাবি তো মন পাবি না।
ভিলেইন বিকট এক হাসি দিয়ে বলত, আরে ওইটাই তো চাই।
এখন কী বলে জানেন? এখন বলে, তুই আমার দেহ পাবি, মন পাবি, কিন্তু মজা পাবি না।
আমাদের দেহ-মন নিয়ে টানা-হেঁচড়া করে করোনা মজা পাচ্ছে কি না এটাই এখন জানা বাকি।
(কোভিড-১৯ এর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক!)
শামীম শাহেদ
কুইন্স, নিউইয়র্ক
২০ মে, ২০২০
shamim_shahed@yahoo.com
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition