২০০১ সালের এপ্রিল। বুলাওয়ে অ্যাথলেটিক ক্লাব মাঠে তিন দিনের ম্যাচ চলছে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রথম বিদেশ সফরে দুই টেস্টের সিরিজ শুরুর আগে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচ। বাংলাদেশ দলে দুই স্পিনার অধিনায়ক নাঈমুর রহমান ও মোহাম্মদ রফিক। এনামুল হক মনি একাদশে নেই। প্যাভিলিয়নের দোতলায় বসে দুজন আড্ডা মারতে মারতে খেলা দেখছি। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরে বেড়াতে থাকা সেই আড্ডা ফিরে ফিরে আসছে ক্রিকেটে। মনিকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা এতে একটুও অবাক হবেন না। খেলোয়াড়ি জীবনে মনির সঙ্গে যখনই কথা বলেছি, মনে হয়েছে, এই মানুষটা ক্রিকেট খায়, ক্রিকেট পান করে, ক্রিকেটে ঘুমায়। খেলা ছাড়ার পর আম্পায়ারিংয়ে আসায় যে কারণে একটুও অবাক হইনি। কোনো না কোনোভাবে মনির ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকারই কথা।
সেই আড্ডায় বিশ্ব ক্রিকেটের সে সময়কার স্পিনারদের নিয়ে কথা হচ্ছে। টাফনেল, ভেট্টোরি, ভেংকটপতি রাজু মুরালিধরন, সাকলায়েন, হরভজন.....। টিভিতে নিবিষ্ট মনোযোগে এঁদের বোলিং দেখেন। শেখারও চেষ্টা করেন। কিন্তু ভেট্টোরি-টাফনেল-রাজু না হয় বোঝা গেল। মনির মতো এঁরাও বাঁহাতি স্পিনার। কিন্তু মুরালি-সাকি-হরভজন তো ডানহাতি অফ স্পিনার। মনি বললেন, 'তাতে কী, আমি ওদের বাঁহাতি বানিয়ে নিই।'
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'সেটি কীভাবে?''
মনির উত্তরটা শুনে একটু চমকেই গিয়েছিলাম, 'টিভির পেছনে একটা আয়না ফিট করে নিয়েছি। আয়নায় ওরা সব বাঁহাতি হয়ে যায়। এতেই হয়ে গেল। ওরা যেমন ফিঙ্গার স্পিনার, আমিও তো ফিঙ্গার স্পিনারই।'
এমন বৈপ্লবিক কোনো উদ্ভাবন নয়। কিন্তু ক্রিকেটার মনির নিজেকে আরও ওপরে তুলে নিয়ে যাওয়ার তাড়নার একটা প্রমাণ তো বটেই।
তা হঠাৎ মনিকে নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ তো আছেই। সকালে উঠেই দেখলাম, আজকের কাগজ ও ভোরের কাগজে আমার এক সময়কার সহকর্মী বড় ভাই ফরহাদ টিটো ফেসবুকে মনিকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেটির শিরোনামে মনিকে অলরাউন্ডার বলায় একজন মন্তব্য করেছেন, এনামুল হক মনিকে তিনি শুধু বাঁহাতি স্পিনার হিসাবেই চিনতেন, তিনি যে অলরাউন্ডার ছিলেন, এটা তার জানাই ছিল না। আরেকজন অনুযোগ করেছেন, সিনিয়র সাংবাদিকেরা এসব না লিখলে তরুণ প্রজন্ম জানবে কীভাবে? সেই দায় থেকেই ১৯৯৮ সালে প্রথম আলোর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটার ও মানুষ মনিকে নিয়ে একটা লেখা আপলোড করার সিদ্ধান্ত। তা করতে গিয়ে মনে হলো, ছোট্ট একটা ভূমিকাও না হয় লিখে ফেলি।
টিটো ভাইয়ের স্ট্যাটাসের নিচে আমার মন্তব্যটা তুলে দিলেও ক্রিকেটার মনিকে কিছুটা বোঝা যাবে। সেটি তাহলে পড়ে নিন----
“বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিং মিলিয়ে লম্বা একটা সময় বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে কার্যকরী ক্রিকেটার ছিলেন মনি। এই বিবেচনায় সন্দেহাতীতভাবে দলের MVP.
ক্রিকেটীয় ওই তিনটি দৃশ্যমান গুণের সঙ্গে অদৃশ্য আরেকটি জিনিস ছিল, যেটি আসলে মনিকে মনি বানিয়েছিল। ফাইটিং স্পিরিট! মনি ছিলেন সত্যিকার এক ফাইটার। এই দিক থেকে তাঁর সময়ের আরেক বাঁহাতি স্পিনারই শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন মনির।”
তিন ভূমিকাতেই মাঠে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। ব্যাটিংয়ে তিনি ছিলেন সত্যিকার 'ক্রাইসিস ম্যান'। তাঁর ব্যাটিং প্রায়ই নিজের দলের ক্রাইসিস কাটিয়ে প্রতিপক্ষের জন্য ক্রাইসিসে রূপ নিত। ব্যাটিংয়ে আক্রমণাত্মক সুরে বাঁধা ছিল বলে খুব দ্রুতই ম্যাচের রং বদলে যেত। পরের দিকে নামতেন বলে বড় ইনিংস সেভাবে খেলা হয়নি। তবে একবার এমন একটাই খেলেছিলেন যে, সেই সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যা অনেকটাই অভাবনীয় ছিল। নয়ের দশকের শুরুতে পশ্চিম বাংলা দলের বিপক্ষে ১৩১ রানের ইনিংসে বিশাল কিছু ছক্কার কথা এখনো মনে আছে। সেই পশ্চিম বাংলা দলে কে কে ছিলেন, সবার কথা মনে নেই। তবে মনির মতোই দুই বাঁহাতির কথা মনে আছে। তাঁরা আবার সহোদর। একজনের নাম স্নেহাশিস গাঙ্গুলী, আরেকজন তুলনামূলক বেশি বিখ্যাত। নাম সৌরভ গাঙ্গুলী।
মনি সম্পর্কে টিটো ভাই আরেকটি কথা বলেছেন, সেটি খুবই সত্যি। চলনে-বলনে একেবারেই সাধারণ, তারকাসুলভ কোনো ভাবই ছিল না। ছিল না কোনো কৃত্রিমতাও। কথাবার্তায়ও ছিলেন চাঁছাছোলা। এটির উদাহরণ হতে পারে, এমন একটা গল্প বলে শেষ করি।
বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের সময় ক্রিকেটাররা হোটেলের লবিতে বসে আড্ডা মারছেন। এমন সময় লবিতে ঢুকলেন আধুনিক গানের এক গায়ক। তাঁর নামটা না হয় না-ই বলি। ভালো মানুষ, তাঁকে অপদস্থ করার কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। তবে একটু বলি, কোনো না কোনোভাবে অভিষেক টেস্টের সঙ্গে ওই গায়কের যোগ আছে এবং আছে এক সময় একটু ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা সূত্রে সামান্য গর্বও। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাই-হ্যালো করার পর হঠাৎ বললেন, ‘আপনাদের একটাই সমস্যা। ব্যাটিংয়ের সময় পা যায় না।’
বলে তিনি চলে যাচ্ছেন।
পেছন থেকে মনি ডাক দিলেন, ‘এই যে ভাই, শোনেন।’
একটু আনুনাসিক সুরে গান গাইতে অভ্যস্ত ওই গায়ক ঘুরে দাঁড়ানোর পর মনি বললেন, ‘বুঝলাম, ব্যাটিংয়ের সময় আমাদের না হয় পা যায় না, কিন্তু আপনি একটা কথার উত্তর দিন তো। মুখ থাকতে আপনি নাক দিয়ে গান গান কেন?’
ওই গায়কের মুখটা কেমন হয়েছিল, অনুমান করে নিন।
উৎপল শুভ্র, ক্রীড়া সাংবাদিক।
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition