জীবন ও জগতের অনিবার্য নিয়মে মেঝো মামা রশীদ হায়দার চলে গেলেন অক্টোবর ১৩- ২০২০। জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে। ’৭১- সালে মনে পড়ে জীবন-মরণ ঝুঁকি নিয়ে আমার মামারা আমাদেরকে নিরাপদে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের ত্যাগ ভুলে যাবার নয়। মেঝো মামার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার অনেককিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মামার মৃত্যু সংবাদে অনেকে শোক প্রকাশ করেছেন। সমবেদনা জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি যে একজন অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানবিকতার প্রতি দায়বদ্ধ সাহিত্যিককে হারিয়েছেন, সে কথাও বেশীরভাগ মানুষ লিখেছেন। আমি তাদের সব কথার সঙ্গে একমত। রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থমালা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গৌরব ও বিপর্যস্তময় সময়ের অনন্য দলিল। সাহিত্য যেহেতু একটি শিল্পমাধ্যম; তাই, সাহিত্য-প্রকাশ-প্রকরণের কৌশল বদলে গিয়ে আজকের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হয়তো অদূর ভবিষ্যতে পুরনো হয়ে যাবে। আজকের সাহিত্যের স্টাইলের প্রতি এরকম আদর-ভালোবাসা আগামী দিনে থাকবে কিনা, জানিনা। কিন্তু, একাত্তর সালে বাঙালি জাতির জীবনে ঘটে যাওয়া অনন্য ও অবিস্মরণীয় ঘটনার আর কোন পুনরাবৃত্তি হবে না। সেই গৌরবের মহিমান্বিত রূপ আর কেউ দেখতে পাবেন না। সেই ঘটনাগুলোকে মামা মুক্তোর মালার মতো যত্ন করে যুক্ত করেছেন তাঁর সম্পাদিত - ‘স্মৃতি -৭১’ গ্রন্থমালায়। অন্তত মহান এই কাজটির জন্য বাঙালিদের কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এটা আমি বিশ্বাস করি। অতএব, তাঁকে হারানোর বেদনা ও অপূরণীয় ক্ষতির কথা সকলে স্মরণে রেখে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। জাতির ক্ষতির এই প্রকাশ দেখে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ক্ষতির যে কান্না, তা আমার একান্তেই রয়ে গেছে! কেননা, তিনি ছিলেন আমার গর্ভধারিণী মায়ের ভাই৷ আমার প্রিয় মেঝো মামা! কত স্মৃতি। কত গল্প। কত আবদার মেঝো মামাকে ঘিরে!
১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি মামা বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার নানাবাড়ি পাবনার দোহারপাড়ায়। আমরা সবাই বিয়েতে গিয়েছিলাম, কতইনা আনন্দ। মামা খুব সুন্দর গান গাইতেন। শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান তিনি খুব সুন্দর করে গাইতেন। মানুষের তীব্র অনুভূতি বড় ছোঁয়াচে। হৃদয়ের আর্তচিৎকারের কান্না যেমন অন্য মানুষকে প্রভাবিত করে কাঁদায়; তেমনি, মানুষের নির্মল আনন্দের হাসিও মানুষকে আনন্দিত করে হাসায়। মনে পড়ে ৬৭ সালে পাবনার দোহারপাড়ায় মামার বিয়েতে গিয়েছিলাম। কত মজা হয়েছিল! এক রাতে নানাবাড়ির ছাদে, মামা অনেকগুলো গান গেয়েছিলেন। একটি গান তিনি এমনই আবেগ ঢেলে গেয়েছিলেন যে, আমার শিশুমনে তা সম্পূর্ণ গেঁথে গিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই গানটি গেয়ে আমি স্কুলে পুরষ্কার জিতেছিলাম। গানটি ছিল ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি/ দেখবে ভারতবাসী...।’ আজ ভেবে অবাক হই, দেশমাতৃকার প্রতি কতটুকু আবেগ ভালোবাসা থাকলে এমন প্রাণ ছুঁয়ে যাওয়া মমতা ও শ্রদ্ধায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির কাহিনী অবলম্বনে লেখা গানটি মামা গেয়েছিলেন, যা আমার শিশুমনে তা চিরদিনের জন্য খোদাই হয়ে গিয়েছিল!
মেঝো মামা আরেকটি বিশেষ কারণে আমার স্মরণে ভাস্বর হয়ে থাকবেন জীবনভর। ৯ মে, ১৯৬১ সালে আমার জন্মের সময়ে, আমার অথবা আমার মায়ের জীবন-মৃত্যু সংকট দেখা দিয়েছিল। সেই রাতটা ছিল প্রচণ্ডভাবে ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড। মামা আমাদেরকে বাঁচাতে সেই ঝড়ের তাণ্ডব উপেক্ষা করে ঔষধ আনার জন্য মিটফোর্ড উদ্দেশ্যে হেঁটে রওয়ানা দিলেন। আমরা তখন আজিমপুর কলোনিতে থাকি। আজিমপুর থেকে যাওয়ার পথে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) এলাকায় ঝড়ের তাণ্ডবে বৃটিশ আমলে লাগানো বিশাল বিশাল কড়ই গাছের বড় ডাল ভেঙ্গে মামার শরীর বরাবর আছড়ে পড়ে। মামা প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন। ঝড় থেমে গেলে একজন পথচারী ভেঙে পড়া ডালের নিচে পড়ে থাকা মামাকে আবিষ্কার করেন। তিনি মামাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সেবাশুশ্রূষা ও যত্নাতীৎ করেন। এদিকে ভাইকে হারিয়ে আমার মায়ের ক্ষোভ দুঃখ আশংকা ও উৎকণ্ঠার সকল ঝড়ের তাণ্ডবে আব্বা একাবারে পর্যুদস্ত। পরদিন মামা ফিরে এলেন। মৃত্যুর কবল থেকে মামাকে ফিরে পেয়ে আমাদের পরিবারে প্রানে পানি পেল। আব্বা আমার মায়ের তাণ্ডব থেকেও রক্ষা পেলেন!
মেঝো মামা আমাকে ও আমার মাকে বাঁচাতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। এই নশ্বর পৃথিবী থেকে এক অবিনশ্বর জীবনের নৌকায় তিনি আজ পাল তুলে দিয়েছেন।
মেঝো মামার আত্মার শান্তি হোক!
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition