কিন্তু আলম তালুকদারের কলম থেমে গিয়েছে। ৮ই জুলাই তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বন্ধু শিশুসাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া এ সংবাদ শুনে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন এভাবে--“আপনি বেশ দীর্ঘাঙ্গী মানুষ ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘজীবী হলেন না কেন? অকারণে অনেকে দীর্ঘজীবী হয়। আপনি কেন জীবনটাকে এত হ্রস্ব করে ফেললেন? এখন আমাদের প্রাণবন্ত রাখবে কে? লেখায় কথায় হাসাবে কে? আমাদের রামগরুড়ের ছানা বানিয়ে আপনি এভাবে অকস্মাৎ চলে গেলেন। আপনার মতো বন্ধু সুহৃদ শুভার্থী আমি অন্তত আর কাউকে পাব না। জীবনের সব কথা আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে পারতাম। হৃদয়ের অনেকটুকু জায়গা আপনি খালি করে দিয়ে গেলেন। খালিই থেকে যাবে। তবু আপনার চিরবিশ্রাম শান্তিময় হোক হে প্রিয় উদার সিংহহৃদয় শুভার্থী বন্ধু আলম তালুকদার।”
বাংলা ছড়াসাহিত্যে এখন উল্লেখযোগ্য একটি নাম আলম তালুকদার। লিখেছেন দুহাতে। ইচ্ছেমতো। ছোটোবড়ো সব পত্রিকায়। আমি দেখেছি লিখে লিখে তোষকের নিচেও রেখেছেন। কেন রেখেছেন সেকথাও আমাদের অজানা নয়। তিনি সেসবের অনেক কাটাছেঁড়া করে যখন খ্যান্ত দিয়েছেন তখন বুঝতে পেরেছি কম্ম সারা হয়েছে। তখন লেখাটি দিয়েছেন কোনো পত্রিকায়। এভাবে তিনি অবিরাম লিখে গেছেন দীর্ঘদিন। ক্লান্তিহীন।
কী লিখেছেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বলা যায় কী লেখেন না তিনি। সবই লিখেছেন। কবিতা লিখেছেন। ছড়া লিখেছেন। গল্প লিখেছেন। নাটক লিখেছেন। প্রবন্ধ নিবন্ধ সবই লিখেছেন। তবে তিনি ছড়াতেই বেশি সাবলীল ছিলেন। এর কারণ ও খুব স্পষ্ট।
বাংলা শিশুসাহিত্য ছড়ার মতো শাণিত কোনো মাধ্যম নেই। যে কোনো বিষয় নিয়ে এই শাখাটি তুঘলকি কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতে পারে। ছড়া এমনি শাণিত যে সমাজের যে কোনো অনিয়মকে চিহ্নিত করা যায় খুব সহজে। অল্প কথার কল্পচিত্র দিয়ে তুলে আনা যায় যে কোনো বক্তব্য। আলম তালুকদার নিজেই বলেছেন, “সাহিত্যে যত শাখা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে শৈল্পিক শাখা হচ্ছে ছড়া।”
ছড়া এমন একটি স্টাইলে পরিণত হয়েছে যে তার প্রতিটি শব্দ মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে যায়। এক দিকে ছড়া হচ্ছে প্রাচীন সাহিত্যের অংশ, অন্যদিকে তা আন্তর্জাতিকতায় পরিপূর্ণ। বলা যেতে পারে জীবন্ত।
আলম তালুকদার তাঁর রসাত্মবোধ দিয়ে ছড়ায় এনেছেন নতুন মাত্রা। শুধু রস নয়, সমাজের অসঙ্গতিগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য রসিকতাও করেছেন। সব বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। মাঝেমধ্যে তাঁর ছড়া শৈল্পিক কারণে কবিতায়ও পরিণত হয়েছে। ছড়ার বই লিখেছেন তিনি একাধিক। তাঁর প্রথম ছড়ার বই ‘ঘুম তাড়ানোর ছড়া’ যেমন আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে লিখেছেন, তেমনি তাঁর হাতেই লেখা হয়েছে ‘চাঁদের কাছে জোনাকি’র মতো স্বপ্নময় সব কাব্যক্রান্ত ছড়া। এসব ছড়ায় খেয়াল খুশির বিষয় আশ্রয় যেমন আছে তেমনি আছে আমাদের চারপাশের সবুজ চত্বর। তিনি ছড়া লিখেছেন সহজ সরলতার। অনেক কঠিন বিষয়কেও তিনি সহজ বোধ্য করে তুলেছেন। স্বঃস্ফূর্ত ভাবকে সঙ্গে নিয়ে তার ছড়াগুলো বাড়তি ব্যঞ্জনা পেয়েছে। বিস্ময়কর ধ্বনিময়তার কারণে রসবান প্রাণোচ্ছল আলম তালুকদারের জীবনের উচ্চারণ হচ্ছে তার ছন্দোবদ্ধ ও প্রাণবন্ত ছড়াগুলো।
আমরা বিশ্বাস করি শিশুসাহিত্যই মানুষের স্বপ্নের কথা সবচেয়ে বেশি বলতে পারে। এমন নিখুঁত সত্যপ্রকাশ আর কোনো কিছুতে হয় না। যারা শিশুসাহিত্য করেন তারা অজান্তেই শিশু হয়ে যান। নিষ্পাপ হয়ে যান। সাবলীল সত্য উৎসারিত হয় তাঁর মনের ভেতর থেকে। এতে থাকে না কোনো ছলাকলা, থাকে না কোনো কালিমা। শিশুসাহিত্যের বিষয় যেমন ব্যাপক তেমনি শিশুসাহিত্য রচনার ভঙ্গিও অবারিত। শিশুসাহিত্য মানুষকে কাঁদাতেও পারে আবার হাসাতেও পারে। মানুষকে ভাবিয়ে তুলতেও তার জুড়ি নেই।
বুদ্ধদেব বসু আমাদের পূর্বসূরি উপেন্দ্র-সুকুমার অবনঠাকুরের যুগকে সোনালি যুগ বলেছেন। এর পরের যুগকে বলেছেন আধুনিক যুগ। এ আধুনিক যুগের প্রতিনিধিরা এখনও আছেন যারা, তারাও অবশ্য মাঝেমধ্যে ফিরে যান সোনালি যুগের কাছে। এটি যেকোনো শিশুসাহিত্যিকের স্বাধীনতা। এখানে কোনো হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না তারা। স্বাধীনতা আছে বলেই আলম তালুকদার সময় সময় সুকুমার রায়ের মতো খেয়ালখুশির রাজা হয়ে গিয়েছিলেন। আবার অনিবার্যভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে ফিরে এসেছিলেন নিজের সমাজে। সমাজের যে কোনো অসঙ্গতিকে তুলে ধরেছেন নিজস্ব রীতিতে।
আলম তালুকদারও একজন সংবেদনশীল লেখক। ‘নাই দেশের রূপকথা’ রচনা করে তিনি তার শক্তিমত্তা প্রচার করেছেন। সম্পূর্ণ রূপকথার ঢঙে লেখা তার এসব গল্প জীবনের কথা বলে।
গল্প লিখতে গিয়ে তিনি কখনও কখনও হারিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপূরুষের কাছে। ফলে তিনি যতটুকুই না গল্প লেখক তার চাইতে বেশি ছিলেন গল্প বলিয়ে। ফলে তার লেখাগুলো রূপান্তরিত হয়েছে বলার ঢঙে। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার বৈকি।
আলম তালুকদার গল্প বলেছেন তরতর করে। অনায়াসে। যেন টপাটপ ঝরে পড়ছিল গল্পগাছের ফলগুলো। আবার নিজস্ব ভাষারীতির কারণে তার লেখার শব্দ চয়নে রয়েছে ছন্দোময় অনুপ্রাস। তার প্রতিটি গল্প কিশোর মনে উজ্জ্বল ও স্বপ্নিল আকাশ নির্মাণ করে। গল্পের পরতে পরতে নতুন মেজাজ, নতুন ঢং বর্ণনার নিপুণ কৌশল বেশ আন্তরিক এবং অভিনবত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। যা কিশোর মনকে আন্দোলিত করে। তার গল্প পড়ে যে কোনো কিশোরের মনোজগৎ সমৃদ্ধ হবে।
১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি আলম তালুকদার টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ ছিল। রম্যসাহিত্যে রচনাতেও তার ছিল আগ্রহ। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৮০।
আলম তালুকদার 'চাঁদের কাছে জোনাকি' ছড়ার বইয়ের জন্য ২০০০ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া পালক অ্যাওয়ার্ড, জয়নুল আবেদিন পুরস্কার, কাজী কাদের নওয়াজ পুরস্কার, পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার, সাহস পুরস্কার, স্বাধীনতা সংসদ পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গের চোখ সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
রহীম শাহ, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক।
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition