করোনার কারণে যখন আমরা এক নিদারুণ দুঃসময় পার করছিলাম, তখনও বিশেষ উদ্বিগ্ন থাকছিলাম এক জন মানুষের জন্য। মানুষটি তাঁর নামের জোরেই যেন অনায়াসে আদায় করে নিতেন সকলের শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসা। আবু তৈয়ব মহম্মদ আনিসুজ্জামান, এই পারিবারিক নামে আজ তাঁর পরিবারই তাঁকে চেনেন কি না সন্দেহ। ‘আনিসুজ্জামান’ বলেই তাঁকে চেনে দুই বাংলার সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্ব-বিদ্যায়তনিক পরিসর।
১৯৩৭ থেকে ২০২০। তিরাশি বছর তিন মাসের মাঝখানে ব্রিটিশ ভারত, পরাধীন পাকিস্তান আর স্বাধীন বাংলাদেশ। আনিসুজ্জামানের জীবন প্রায় এক শতাব্দীর ভাঙাগড়া ও বাঙালির ইতিবৃত্ত। পার্ক সার্কাস হাইস্কুলের ছাত্র, ‘মুকুলের মহফিল’-এর সদস্য আনিস দশ বছর বয়সে কলকাতা ত্যাগ করে খুলনায় আসেন। তার পর থেকেই আনিসুজ্জামান মানে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে ক্ষান্তিহীন সংগ্রাম। প্রথম জীবনে ছোটগল্প লিখতেন। তার পর জনজীবনের জঙ্গমতাই যেন তাঁকে টেনে নিয়ে আসে প্রবন্ধ-গবেষণার দরবারে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী ও কেন?’ তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সম্মুখ সারির যোদ্ধা। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়ে আমৃত্যু এই বিভাগকে মহিমামণ্ডিত করেছেন— অতুলনীয় মেধাবী ছাত্র হিসেবে, বাঙালি মুসলিম মানস (১৭৫৭-১৯১৮) বিষয়ে অসামান্য গবেষণার প্রণেতা হিসেবে, গুণী শিক্ষক হিসেবে এবং এক পর্যায়ে বিভাগের ‘এমেরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে। ১৯৬১-তে পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের বিরুদ্ধতা করে, তখন চব্বিশ বছরের আনিসুজ্জামান যে বিদ্রোহী ভূমিকা নেন, তা ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের রবীন্দ্রপ্রাণতার প্রতীক। ১৯৬৪-তে প্রকাশিত ‘মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বঙ্গীয় গবেষণা জগতে আজ অবধি এক অপরিহার্য সহায়সূত্র। সে বছরই শিকাগোতে গিয়েছেন পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে। কিন্তু আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ১৯৬৫-তে তাঁর মাসাধিক কাল লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজ়িয়াম লাইব্রেরি ও ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন আর গবেষণা। সেই সময় থেকেই মনের মাঝে উপ্ত হওয়া ধারণা পনেরো বছরের সাধনায় রূপ পায় ১৯৮১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘ফ্যাক্টরি করেসপন্ডেন্স অ্যান্ড আদার বেঙ্গলি ডকুমেন্টস ইন দি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডস’ রূপে। ১৯৮২ সালে ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ এবং ১৯৮৪-তে প্রকাশিত ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’-এর মতো সমীহ-উদ্রেককারী গবেষণা এর ঠিক পর পরই।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আনিসুজ্জামান ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। সেই সময় কলকাতায় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ তিনি তাঁর আত্মকথায় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য প্রণয়নের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তাঁরই উপর, কেননা তাঁর উপর প্রভূত আস্থা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাজউদ্দিন আহমদের মতো নেতাদের। আনিসুজ্জামান অনেক কাল ছিলেন রাজধানী ঢাকার বাইরে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার কারণে গিয়েছেন দিল্লি, করাচি, সান ফ্রান্সিসকো, ব্লুমিংটন, মনট্রিল, লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ়, অক্সফোর্ড, সাসেক্স, টোকিয়ো, কিয়োটো। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে গিয়েছিলেন মস্কো বা বুডাপেস্ট। এক ব্যক্তিগত আলাপনে তিনি আমায় বলেছিলেন, তাঁর জীবনে সাংগঠনিক সক্রিয়তায় এত সময় গিয়েছে যে নিজের প্রার্থিত লেখাগুলো হয়ে ওঠেনি ঠিকঠাক। বিস্মিত হয়েছিলাম। এত সবের মাঝেও তবে কী করে লেখা হয়েছিল ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘মুনীর চৌধুরী’, ‘বাঙালি নারী: সাহিত্যে ও সমাজে’, ‘ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’-র মতো দিগদর্শী সব বই! দক্ষ হাতে সম্পাদনা করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘নজরুল রচনাবলি’, ‘শহীদুল্লাহ রচনাবলি’ কিংবা ‘ত্রৈলোক্যনাথ রচনা-সংগ্রহ’। অনুবাদ করেছেন অস্কার ওয়াইল্ডের নাটক, পুরোধা হয়েছেন ‘আইন শব্দকোষ’, ‘বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ’ প্রণয়নে। তাঁর আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’ কেবল আত্মকথা নয়, বাংলার এই জনপদের ক্রমিক অগ্রগতির বিশ্বস্ত ও নিরাসক্ত ভাষ্যও বটে।
বুদ্ধিজীবীর কেতাবি গণ্ডি ভেঙে রাজপথে-জনপদে, মাটির টানে মানুষের মিছিলে আমরা তাঁকে নেমে আসতে দেখি। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা রুজু করতে, কিংবা ১৯৯২ সালে গণ-আদালতে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপনকারী হিসেবে সামনে দাঁড়াতে দেখি। ১৯৯২-তে তাঁর এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তিকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে দেখি। এই সে দিনও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠী তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে হত্যার হুমকি দেয়।
তবু আনিসুজ্জামান মানে এগিয়ে যাওয়া। তাই অসুস্থ শরীরে, জরাকে উপেক্ষা করে সভা-সমাবেশে স্বচ্ছন্দ থাকতেন সব সময়। তাঁর উদার দুয়ারে সবার প্রবেশ ছিল অবাধ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তিনি, ছাত্র-শুভার্থী-স্বজন সকলেরই ‘আনিস স্যর’। এই ভূষণ আরোপিত নয়, এ তাঁর অর্জন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত, ‘জাতীয় অধ্যাপক’-রূপে সম্মানিত, ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে গৌরবান্বিত আনিস স্যরের সবচেয়ে বড় পাওয়া মানুষের অনিঃশেষ ভালবাসা, আজীবন।
পিয়াস মজিদ (কবি ও গবেষক)
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition