একটা সময় ছিল মেয়েটার। থাকে, আছে এখনো অনেকেরই। ষোলো-আঠারোর আঠালো প্রেমে তখন প্যারাসুটের মায়া ভুলে চুলের সিঁথিতে সানসিল্ক মাখে মেয়েটা। থ্রিপিস কামিজের পৌনে দুই হাত ওড়নার আড়ালে পরানটুকু খেলে আবেগ। বয়সটা হাসে হেতুক-অহেতুক বা ব্যাকরণ-অব্যাকরণে! সেই সময়টাতে মেয়েটা নিজেকে পরী ভাবত। আর মনে করত পরীরা বিয়ে করে না। বিয়ে একটা যন্ত্রণা। প্রেমেই তাদের ওড়াউড়ি। আজ ক্লাসমেটের কলারের ভাঁজে তো, কাল ভীমরতি ধরা বৃদ্ধের কলাপসিপল গেটে ঠাই দাঁড়িয়ে!
এমন করেই মেয়েটার ১৬ কাটে। প্রিয় নির্ভরতায় কাটে বাবার বুড়ো আঙুল ধরে দিতে যাওয়া এক একটা বার্ষিক পরীক্ষা। এভাবেই বড় হলে প্রাথমিক কিংবা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক হব—এমন ভাবনাগুলোর দিন শেষ হয় একদিন।
এরপর বাবার কোলে সময়ে–অসময়ে ঝাঁপিয়ে পড়া মেয়েটা একটু অন্য রকম হয়ে যায়। বাবার কাছে যায়, তবে আগের মতো কোলে উঠে পড়ে না হই হই করে। বাবাকে পুরুষ ভাবে। বাবার থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রাখে। বাবার ওষুধের ছোট বক্সটা বিছানার পাশে প্রতি রাতে খুব যত্ন করে রেখে আসে। পৃথিবীর সেরা পুরুষ তার বাবা এই ঘোরে, মাকে বকে পারিবারিক আদালতে। বাবার অগোচরেই, বলে, ‘খবরদার আম্মু! আব্বুকে বকলে তোমাকে কিন্তু তোমার বাবার কাছে রেখে আসব। দুষ্ট মহিলা একটা!’
এ সব বলে চেঁচামেচি করে। বাবার ভুল হলেও মা দোষী! মেয়েটা পক্ষপাতদুষ্ট রোগে ভোগে। এত আদরের বাবা। কতদিন এই কথা ভাবে, বাবার ছায়ার মতো, তেমন ব্যক্তিত্বের কোনো ছেলে যদি এসে বলে, ‘এসো হরিণী!’
বাবার জন্য পাগল হরিণী শেষমেশ বাবাকে কষ্ট দিয়ে ছেলেটার হাত ধরে পালিয়ে যাবে কি না, কে জানে! ছেলেটা যে ওর বাবার মতো করেই ওকে আগলে রাখার সমস্ত দায়িত্ববোধ আর মায়ার আদলে তৈরি। তেমন করেই ওকে ভালোবাসবে, যেমন করে মাকে বকলে বাবার চোখে আলতো বোঝাপড়া দেখত হরিণী। ঠিক মায়ের চোখের তারায় চেয়ে থেকে বাবার বোঝাপড়া! সে চোখের পাড়াতে বিশ্বাস থাকবে। সে চোখের মহল্লাজুড়ে মনের মতো সঙ্গী পাওয়ার তৃপ্তি থাকবে। আরও থাকবে দুই-এক বেলা খুনসুটি!
হরিণী এখন কলেজে যায়। বিউটি বক্সে রাখা কাজলটার নিত্য ক্ষয় সে কথা বলে। কাজল মেয়েটার প্রতিদিনের সাজগোজ। আয়নায় সেটে থাকা প্রতিদিন কপালে পরে যাওয়া ছোট্ট কালো টিপটা বলে দেয়, তুমুল এক বসন্ত দিন কাটছে এখন!
এমন বসন্ত দিনে অনেক কিছুই হতে ইচ্ছে করে হরিণীর। কলেজের ম্যাডাম হতে ইচ্ছে করে। ম্যাডাম আর পুরুষ শিক্ষকেরা এক টেবিলে বসে চা খান, হাসে। কতদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে গিয়ে দেখেছে সে। আঠারোর আলোতে মেয়েটা স্বভাবজাত বয়সের প্রেমের ফানুশ ওড়ায় বয়সের খেয়ালে। বাসার ব্যালকনিতে নিজ হাতে রোপণ করা গোলাপের টবে স্বপ্ন রোপণ করে! স্বপ্নগুলো সবুজ রং।
সবুজ স্বপ্নের শাখার সঙ্গে সখ্যে মাতে কিশলয় আনন্দে। সকাল-সন্ধ্যা পানি ঢালে গাছের মাটিতে। পড়াশোনার গোড়ায়ও পানি দিত নিয়মিত। ফলে কলেজের বেঞ্চিতে দুই বছর কাটিয়ে এইচএসসি পাস নামের ফুল দেয় হরিণী।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। খারাপ না। বেশ তো। কেমন বড় বড় লাগে ঊনিশে। অনার্স ব্যাপারটাতেই অনার অনার অর্থাৎ সম্মান জাতীয় একটা কিছু থাকে। সেটাই লাগতে লাগল হরিণীর। আরও একটা জিনিস লাগত। অনার্সের ছেলে ক্লাসমেটগুলোকে তার বাচ্চা বাচ্চা লাগত। ইমম্যাচিউরড লাগত। যাদের ম্যাচিউরিটি কম, তাদের সঙ্গে তুই তোকারি করতে আন ইজি লাগে না। পাশে বসলেও না!
এ সময়টাতে মেয়েটার আর শিক্ষক হতে ইচ্ছে করে না, তাঁদের বউ হতে ইচ্ছে করে! প্রফেসর আর অধ্যাপক এক বিষয়কেই সে আলাদা করে। অধ্যাপকেরা ক্লাসে প্রেমের কথা বলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বান্ধবীর সঙ্গে বাদাম খাওয়ার কথা বলে! কেউ কেউ ঘরে মশা কামরায়, মশারি টাঙ্গানোর কেউ একজন নেই, সেটাও বলে!
হরিণী এসব ভাবনাদের ভ্যানিটি ব্যাগের গোপন পকেটে চেন লাগিয়ে রাখে। শুক্র-শনিবার বাদে বাকি দিন এসব প্রেমপরী ভাবনা নিয়ে ক্যানটিন, পাহাড়ের কোলে কোলে হাঁটে। আলাদা একটা ভাব নিয়ে ঘোরে। প্রেমে ওড়াউড়ি মেয়েটার ভালো লাগে। কিন্তু বিয়ে ভালো লাগে না। ক্লাস টেনে বিয়ে হয়ে যাওয়া বান্ধবী রায়া বলেছে, বিয়েশাদি একটা যন্ত্রণা। বাচ্চাকাচ্চা আরও যন্ত্রণা। স্বামী-শাশুড়ি তো আরও মহাযন্ত্রণা!
যদিও মেয়েটা প্রতি ভোরে তার ভাবির ভেজা চুল দেখতে অভ্যস্ত ছিল। সেই ভেজা মাথায় ভাবিকে অপ্সরার যমজ বোন মনে হতো। একজন স্বর্গে, একজন মাটিতে। এত সুন্দর লাগত, তবুও হরিণী বিয়ে করবে না। বিয়ে মানেই নামের শেষে অন্যের মালিকানা। হরিণী মোস্তফা কিংবা অহনা আলম এই সেই কত কী! এই কথা পাশের বাসার জহির ভাইয়ের বউও বলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমম্যাচিউরড ক্লাসমেটরাও বলেছে। ছেলেগুলো বলে, ‘দেখিস, কোনো মতে থার্ড, ফোর্থ ইয়ার যাক, একটা পাখিও আর থাকবে না। সব পাখিই অস্তিত্ব হারাবে।’
মেয়েটা তখন সকালবেলায় ব্রাশ করা সামনের ছয়টা দাঁতকে কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘দেখিস, থাকি কি না!’
মেটগুলো দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘দেখব, পেপসোডেন্টের জোর কত। আমরা তো সেনসোডাইন দিয়ে মাজি! হে হে।’
এভাবেই আঠারো শেষ মেয়েটার। উনিশের ঘরে পা নেই, বিশ এর ঘরেও স্থির হয়নি। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। অনার্স ফাস্ট ইয়ারেই! বান্ধবীরা আকাশ থেকে পড়ল।
কি বলিস হরিণী, তুই বিয়ে করছিস?
করছি না। দিচ্ছে।
হরিণীর নির্লিপ্ত জবাব। হরিণী নামটা মেয়েটার বাবার দেওয়া সম্পত্তি। হয়তো এর সঙ্গে এখন আলম-শাহআলম-মোস্তফা-ফোস্তফা একটা কিছু যোগ হবে। ভেবে হরিণী একটা নিঃশ্বাস একটু টেনে ফেলল, যা দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনাল।
কালকে হরিণীর বিয়ে। হরিণী মনে মনে চিন্তা করল, কল দেবে রায়াকে, একটু ধারণা নিতে। রায়া হয়তো রান্না ঘরে কাজ করছে। খাবারের আয়োজন করছে। ভাবল রায়াকে আর বিরক্ত না করি। রায়াই তো বলেছিল, সংসারে সং সেজে থাকতে হয়। সংসার মানেই মহাযন্ত্রণা। ব্যস্ততার আড়ালে নিজের সত্তাকে হারানোর বীভৎস বসবাস! চোখে ময়লা পড়ছে, এই অজুহাতে কান্না লুকানোর কাহিনি সবে ঠাসা সঙের সারমর্মই হলো সংসার!
আজ হরিণীর বিয়ে। বিয়ের দিনে হরিণীর নিজেকে পরী মনে হয়নি। প্রাণী মনে হয়েছে। স্টেজের সামনের মেয়েপক্ষের ৪০০ আর ছেলেপক্ষের লোকজনসহ বাড়তি আরও ১০০ লোকের সামনে বসে হরিণী। কেউ সে লম্বা কি না দেখছে। কেউ বাপের দেওয়া অলংকারের খাদ আর ক্যারট দেখছে। কেউ পাশে বসে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে আলাপ বা জিজ্ঞাসা করছে!
রাত শেষ। শেষের ভোরে মেয়েটাকে কি মেয়েটার ভাবির মতো দেখাচ্ছিল? অপ্সরার তৃতীয় যমজ বোন! তা আবার হয় না কি! মেয়েটা অবশ্য এসব ভাবল না। কারণ মেয়েটার দুই ডজন চুরির হাতটা নড়াচড়া করা জামাই বলেছে, তুমি সুন্দর।
এই সুন্দর শব্দটা পরী শব্দের থেকেও বেশি সুন্দর লেগেছে হরিণীর। হরিণী তারপর আহ্লাদে জানতে চায়,
আমার গায়ের কী রং?
জামাই বলল, তুমি সাদা না, ফর্সাও না। কালো না, কাচি হলুদও না। তুমি স্বর্ণহলুদ।
অতঃপর রিনিকঝিনিক নূপুরটা খুলে পড়ে বিছানায়। জানালার পর্দাটা সূর্যকে ঢেকে রাখে। হাতের চুড়িগুলো নির্লজ্জের মতো বাজতে থাকে। সকালবেলার টিক টিক ঘড়ির কাঁটা সতর্ক করে বলতে বলে, ধুত! সরো! সরো তো বেহাইয়া! এরপর জানালার পর্দা মেলেই সুর্যের সামনে দুই জোড়া চোখ, চোখে চোখে চেয়ে বলে ওঠে, বোঝো! আমি কে!
এক চিমটি খুনসুটিতে লজ্জাবতী হরিণী নতুন জামাইয়ের খোলা শার্টের গেঞ্জির বুকে পড়ে। মেয়েটা ভাবে, এতসুখ...এতসুখ...! তবে যে রায়া বলেছিল স্বামী একটা যন্ত্রণা!
সপ্তাহ পর মেয়েটা বিয়ের পর প্রথম ক্যাম্পাসে আসে। মূল ভবনের দোতলায় ক্লাস। ক্লাসে যাবার আগে নাকফুলটা গাড়িতেই খুলে রাখে। ক্লাসমেট ছেলেদের সেনসোডাইনের হাসির কথা সে ভুলে যায়নি। তবে কাছে বসা বান্ধবীরা ঠিক টের পেয়ে যায়।
মেয়েদের অসম্ভব রকম অনুমান ক্ষমতা। গন্ধ শুকেই সব বলে দিতে পারে। বিয়ের পারফিউমের ঘ্রাণে ভরে আছে শরীর। উঠোনের গাছের মেহেদী পাতার রাজত্ব হাতজুড়ে। তাছাড়া গ্রীবা ছুঁয়ে আসা রক্তজবা দাগটাও বেশ স্পষ্ট। প্রথম প্রথম তো!
বান্ধবীদের একজন একটু বেশি অ্যাডভান্সড। সব কিছুরই রকম-সকম বোঝা পাকনা। নাম সুমি। হরিণীকে বলেই বসল,
তো হরিণী, ‘কেমন লাগল বিয়ে করা?’
‘ভালোই, খারাপ না’ হরিণী উত্তর করে।
উত্তরের আশায় বসে না থেকে সুমি বলতে থাকে, ‘তিন মাস যাক, তবেই বুঝবা কত্তো ধানে কত্তো চাল, খেলা কারে বলে!’
হরিণী ভয় পেয়ে যায়। খেলা? এরপর কী অন্যরূপ দেখব! অন্য মানুষ! তিন মাস পর হরিণীর প্রিয় শিক্ষকই প্রশ্ন করে,
‘বিয়ে তো আমার আগেই করলি পাগলি। সেদিক থেকে তুই তো এক্সপেরিয়েন্সড। তো বিয়ে বিষয়টা কেমন, ভালো?’
হরিণী নিজের বিয়ের আগের বিবাহিত সব বান্ধবীদের তথ্য–উপাত্ত নেগেটিভ বিশ্লেষণকে ভুল প্রমাণ করে বলল খুব পজেটিভলি।
‘ভালো, অনেক ভালো, নিজের জন্য অন্য কেউ ভাবে, নিজেকে ভাবতে হয় না।’
‘বিয়ের আগের এবং পরের জীবন, তফাৎ কী?’ স্যার আবারও জিজ্ঞেস করে হরিণীকে।
শিক্ষকের কাছে সব সময়ই নতুন বাক্য, নতুন সেনটেন্স শিখতে বসা শ্রদ্ধাভাজন টিউটরকে শেখাল হরিণী।
দুইটা ভিন্ন দুই জগত। দুইটাই সুখের, যদি সুখটা কেউ খুঁজে নিতে পারে!
বাহ! শিক্ষক বলল।
ভালোই কাটছে সময় সব। এভাবে ছয়মাস হরিণীর উপভোগের চুমুকেই কেটে গেল। স্বজন-পরিজন এবার বলল, বছর তো যাক। তবেই মানুষ চেনা!
হরিণী নামের মেয়েটা এবার বছরও কাটিয়ে ফেলে। এক বছর, দুই বছর, তিন বছর, চার বছর।
এখনো কাউকে কাউকে বলতে শোনে হরিণী, চার-পাঁচ, এ আর এমন কী! ৩০ বছর কাটাও, তবেই বুঝবা বিয়ে কত্ত যন্ত্রণা!
হরিণী সে সব আর ভাবে না আর। সে এখন স্বামীর অনামিকা ধরে প্রিয় নির্ভরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় প্রতি সকালে। যেমন নির্ভরতায় বাবার আঙুল দুটোকে বটবৃক্ষ মনে হতো ওর স্কুল জীবনে। মনে হতো, বাবা যেমন করে মায়ের দিকে বোঝাপড়ায় তাকাত; ঠিক তেমন করে তাকিয়ে তার স্বামীটাকে নিয়ে ভীষণ রিস্কি রাস্তায়ও হাঁটা যায়। বিশ্বাস হয়, তার মানুষটা তার পাশে থাকলেই কোনো ভয় নেই।
আর মাঝে মাঝে ৩০ বছরের পরের মানুষটার পরিবর্তনের নমুনা দাঁড় করায়। ভাবে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস না করাটা কি খুব খারাপ!
- জাহান রিমা, ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition