২০০৫ সালের জানুয়ারি। তখন আমি চারুকলায় ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করি। ঝিনাইদহ থেকে সবে ঢাকায় এসে উঠেছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলির একটি মেসবাড়িতে। কয়েকজন বন্ধু মিলে একসঙ্গে থাকি। তখন তো আজকের মতো মোবাইলের এমন রমরমা ছিল না। আমারও ছিল না মোবাইল।
ঢাকা শহরে এসে স্বাধীনভাবে নিজের মতো বেড়ে উঠতে চেয়েছিলাম আমি। ফলে বাড়ির কাউকে আমার ঢাকার ঠিকানা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করিনি। আরও সত্য কথা হলো, পরিবার থেকে সে সময় নানা কারণেই আমি বিচ্ছিন্ন থাকতে চাইতাম (যদিও আজ বুঝতে পারি, এগুলো ছিল আমার মধুর ভুল, ভুলে ভরা জীবনযাপনের অংশ)। তাই ঝিনাইদহ শহরবাসী আমার বাবা তখন তাঁর একমাত্র ছেলের ঢাকায় থাকার আস্তানার ঠিকানা জানতেন না। তাঁকে শুধু বলেছিলাম, আজিজ মার্কেটে গেলেই আমাকে পাওয়া যাবে।
আদতে সে সময় আজিজ মার্কেটেই তো ছিল আমাদের ঘরবাড়ি। তখনো মার্কেটটি কাপড়ের মার্কেট হয়ে যায়নি। আর সে সময় প্রতি সন্ধ্যায় এ মার্কেটটি রাঙিয়ে তুলতাম তো আমরাই।
প্রতিদিন বিকেলে চারুকলাতেই হতো কোচিং। কোনো মতে কোচিং শেষ করে আজিজে এসে বাংলা সাহিত্যের রাজা-উজির না মারলে আমাদের পেটের ভাত হজম হওয়ায় ছিল কষ্টকর।
এমনই এক সন্ধ্যায় ২০০৫-এর জানুয়ারিতে চারুকলা থেকে কোচিং শেষ করে ফিরছি, জাদুঘরের সামনে আসতেই বন্ধুরা পাকড়াও করল আমাকে। খুবই উত্তেজিত তারা, আমাকে কেবল বলছিল, তুই তোর বাবাকে তোর ঢাকার ঠিকানা দিসনি কেন!
আমি তাদের মুখেই প্রথম শুনলাম, আব্বা এসেছেন। এত বড় ঢাকা শহরে আমাকে কোথায় খুঁজবেন তিনি! তাই এর-ওর কাছে শুনে শাহবাগের আজিজ মার্কেটে এসে সরাদিন বসে আছেন, এখানে কখন আমি আসব সেই অপেক্ষায়।
সন্ধ্যা নেমেছে। রাজধানীর সোড়িয়াম বাতিগুলোও জ্বলে উঠেছে। আর আজিজ মার্কেটের কাছাকছি এসে দূর থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি, মলিন পাঞ্জাবি পরা একজন মানুষ তার ছেলের অপেক্ষায় পেট ফোলা একটা ব্যাগ নিয়ে একাকী বসে আছেন। তিনি বসে আছেন আজিজ মার্কেটের পাশে পিজি হাসপাতালের যে ঘোরা দেওয়া জায়গা ছিল সেখানে। (এখন আর কেউ সেই জায়গা খুঁজে পাবেন না, সেখানে এখন পিজি হাসপাতালেরই সম্প্রসারিত নতুন ভবন গড়ে উঠেছে। তবে যখনকার কথা বলছি, সে সময় ওখানে ইটের ঘেরা দেওয়া ছিল, যার ওপর পথচারীরা বসে দু-দণ্ড জিরিয়ে নিতেন)।
তো আব্বাকে সেদিন দেখছিলাম দূর থেকে। সন্ধ্যার অন্ধকার তাঁর সারা মুখে। মুখটা মলিন, সূর্যাস্তের মতো।
গবতলীতে বাস থেকে নামার পর এখনো দানাপানি কিছুই যে তাঁর পেটে পড়েনি, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম তাঁকে। তিনি আমাকে খেয়াল করেননি, কেবল রাস্তার দিকে চোখ মেলে ছিলেন। তাঁর সেই চহনির ভাষা মুহূর্তেই পড়তে পেরেছিলাম, পুত্রের জন্য প্রতীক্ষা।
তখন আমার কেমন যে লাগছিল! এ জীবনে আব্বার কোনো কথাই শুনিনি, নিজের মতো চলেছি, তাঁর সঙ্গে আমার মত, পথ, রুচি ও প্রজন্মগত ব্যবধান বিস্তর, দুরত্বও ছিল বিশালাকারের।
তবু সেদিন সন্ধ্যায় সোডিয়ামের সেই ঘোলাটে আলোয় দূর থেকে তাঁর মলিন মুখ দেখে আমার কেবল মনে হলো, আব্বা- আমার আব্বা তো সূর্যাস্ত হয়ে যাচ্ছেন! ওই যে সূর্যাস্ত হয়ে অন্ধকারে নুয়ে পড়ছেন। প্রবল অপরাধ বোধে আমার তখন মনে হয়েছিল আরেকটি কথাও, এই মানুষটাকে আমি জীবনে কখনোই কোনো চিঠি লিখিনি, লিখতে পারিনি, লেখার প্রয়োজনই অনুভব করিনি আসলে।
আর ওই বিষণ্ন মুহূর্তেই আমার মাথার ভেতরে উদিত হলো একটি লাইন-‘“বাবা” শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, কখনো যাদের কাছে চিঠি লেখা হয় না এমন মুখ।’
মনে আছে, ওই রাতে ঢাকার মেসবাড়িতে বসে প্রবল অপরাধে ঘোরগ্রস্তের মতো লিখেছিলাম একটি কবিতা-‘শুকনো পাতা ঝরার বনে’, যার প্রথম লাইনটি হলো, ‘বাবা শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, কখনো যাদের কাছে চিঠি লেখা হয় না এমন মুখ।’
নিঃশব্দ রাত। আমি লিখছি আর আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে, কবিতা লিখতে গিয়ে এমন খুব কমই হয়েছে আমার।
বলার কথা হলো, ‘শুকনো পাতা ঝরার বনে’ নামে এই কবিতাটি পড়লে এখনো মন খারাপ হয় আমার। কারণ, এই কবিতার শব্দগুচ্ছের মধ্য দিয়ে আব্বার মলিন, বিষণ্ন, ক্ষুধার্ত সেই মুখটি আজও যে আমি দেখতে পাই!
কবিতাটি ২০১১ সালে বেরোনো আমার প্রথম কবিতার বই ‘রাত্রির অদ্ভুত নিমগাছ’-এ আছে। এখানেও সংযুক্ত করলাম, যাতে বাবা দিবসে মন চাইলে আপনারা কবিতাটি পড়তে পারেন।
শুকনো পাতা ঝরার বনে || আলতাফ শাহনেওয়াজ
'বাবা' শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, কখনো যাদের কাছে চিঠি লেখা হয় না এমন মুখ। অগোছালো পতনের চক্ষে ডাগর আঁখির নিঃশব্দ পুকুরে যারা চুবিয়ে রাখেন চুল ঝাঁকড়া সূর্যের জ্বলন্ত শিরদাঁড়া; কব্জি-কাটা দিনের টুকরো-টাকরা কুড়িয়ে চন্দ্র-ফুড়ূৎ রাত্রির আলখাল্লা সেলাই করেন—করতে করতেই এক পৃষ্ঠার নির্বাচিত গোধূলি, উড়ন্ত ছাই... বলা ভালো, সূর্যাস্ত হয়ে যাচ্ছেন! এ ছাড়া ঝরাপাতার প্রসঙ্গ উড়িয়ে তৎক্ষণাৎ যেহেতু শীতকালকে বোঝানো যায়; তাই ঝরাপাতা-উলে বোনা শীতকাল ‘আমার ছেলে’ নামে যে বই লিখেছে, সেটির লেখক বাবা নামের যারা, হারানো বনভূমির স্তন উঁচানো হাওয়াকে বুঝতে পেরে, তালাশ পাখির ঘ্রাণকে ভেবে, কবেই তারা ঝরিয়ে দিলেন সূর্যগাছের পাতাপুতি- সূর্যিপাতা সূর্যিপাতা...
এর মাঝে অন্ধকার সূত্রে চাঁদ যখন মামা হয়ে যায়, ডাকি—টিপ দাও চাঁদমামা, আয় আয় আয়...না চিনিলাম মাতা-পিতা, না বুঝিলাম হিয়া... তোমারও মন, না জানি কৃষিকাজ...উড়ে যাচ্ছে পুড়ে যাচ্ছে আবাদবিহীন আয়ু।
পুনশ্চ 'বাবা' শব্দটি লিখতে, হিমসম ঘনঘোর শাদা পৃষ্ঠায়, দুর্বোধ্য আমার বাবা শব্দটি—হয়তো বা বাজপড়া লেখার খাতায়, হয়তো বা ডানা ওড়ার শব্দ চিরে কেবলই সূর্যাস্ত হয়ে যাচ্ছেন। তাকে বলা ভালো, কী লিখি কী লিখি...
Chairman Of The Board: Syed Shamsul Alam
Editor in Chief: Tahsen Rashed Shaon
SHOKHOBOR24.COM
2994 DANFORTH AVE. | SUITE# 201
TORONTO. ON. M4C 1M7. CANADA
COPYRIGHT © 2019. ALL RIGHTS RESERVED. BY Shukhobor24.com About Us Privecy & Policy Terms & Condition