‘আরো ভয়াবহ সময় সামনে আসছে’

By: তাওহিদ মিলটন ২০২০-১০-০৬ ১০:৪৭:০৩ এএম আপডেট: ২০২৪-০৪-১৬ ১১:০২:৪৫ এএম মতামত
অনলাইন থেকে নেওয়া

যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ!

পুরাণের কথা।

নতুনের কথা হলো, যে যায় ক্ষমতায় সেই হয় দুর্নীতিবাজ। গানে গানে যদি বলি, এক হাতে ক্ষমতা তোমার অন্যহাতে দুর্নীতি। 
দুদকের গত ১ বছরের ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, যত দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে তারা মামলা করেছেন, কিংবা যত দুর্ণীতিবাজ তারা ধরেছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবেই ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। কারো হাতে ছিল ক্ষমতার স্টিয়ারিং, কেউ পাশের সিটের যাত্রী। একজনও সাধারণ মানুষ নেই! এদেশের সাধারণ মানুষ ধোয়া তুলসি পাতা! এই তুলসিপাতাগুলোকে ধরে ক্ষমতা বলয়ের আশেপাশে নিয়ে যান, এরা আর তুলসিপাতা থাকবে না, তখনই এরা হয়ে যাবে বিষাক্ত বিচুটি পাতা। এই হলো আমাদের ইমান। এতই শক্ত যে ক্ষমতার আবেশে অবশ হয়ে যেতে সময় লাগে না।
 
আমাদের সিনেমায় নায়ক একা পিটায়া তামা তামা করে ফেলে, আমরা হাততালি দেই। নায়কের কোনো বিচার হয়না। আমাদের নায়করা মারামারি করে, জোর করে প্রেম করে, ইভটিজিং করে, কনসেন্ট ছাড়া অনেক কিছুই করে নায়িকার সাথে, চিৎকার করে কথা বলে, নায়কের পেশিশক্তি দেখে নায়িকা মুচকি হাসে। নায়কের পড়াশোনা করা লাগে না, নায়ক কখনো বই পড়ে না, রঙবাজি-মাস্তানি করলেও মেয়েরা প্রেমে পড়ে। নাটকেও একই। আমরা দেখাইছি এটাই কুল। তাই এটাই হচ্ছে চারপাশে। চারিদিকে আজ যে মোরালিটির ক্রাইসিস, আজ যে হাহাকার সেটাতো একদিনে একটা মাধ্যম থেকে আসেনি। এসেছে চারপাশ থেকে। প্রতিটি মাধ্যমই তার দায়িত্ব পালনের সময় ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি। কেউ না। সমাজে যা চলে তাই নাটক সিনেমায় আসবে, নাকি নাটক সিনেমারও কিছুটা দায়িত্ব ছিল একটা পরিবর্তিত সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কি রকম হতে পারে সেটা দেখানো। একটু একটু করে মোরালিটি পুশ করা। ভালো-মন্দের মাঝে পরিষ্কার লাইন টানা। আসলে আমরা কেউই নিজেরাও সেই সমাজটা দেখতে পাইনি। যে যার যার জায়গা থেকে শুধু বর্তমানটাকেই গুরুত্ব দিয়ে গেছি। নাটক সিনেমা টিভি পত্রিকা সবাই এখানে একই। একই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ও।
 
একটা বড় সময় এভাবে গেছে। 

সুতরাং একটা বড় সময় ধরে এর প্রভাব থাকবে। 

সেটার জন্য আমরা হয়তো প্রস্তুত না। কিন্তু শুধু একটা সিলেট কিংবা নোয়াখালির ঘটনা নয়। সামনে আরো আসবে। 

আর বিচার ব্যবস্থার কথা কি বলবো! 

জাঁ জাক রুশোর সোস্যাল কন্টাক্ট বইয়ের একটা কথা প্রায় সবসময় মনে পড়ে। আইন প্রনয়নের সময় যতটা সম্ভব মানবিক হওয়া উচিত, কিন্তু প্রয়োগের সময় সর্বোচ্চ কঠিন হওয়া উচিত। 

আমরা জগতে সবকিছুতেই একটা উল্টা জাতি। এখানেও তাই। আমরা আইন প্রণয়ন করি সর্বোচ্চ কঠিন হয়ে, কিন্তু প্রয়োগের সময় আমরা হয়ে যাই প্রচণ্ড  মানবিক। তখন আমরা দল দেখি, আত্মীয় দেখি, বন্ধু দেখি। অপরাধির অনেক শেল্টার দেয়া বড় ভাই থাকে আমাদের। আমরা অপরাধিকে দল থেকে বহিষ্কার করে দিয়ে দলকে কলুষমুক্ত করি। খুব আধুনিক সিম্পল সিস্টেম আমাদের। অন্যের ঘাঁড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে আমরা নিজেকে কলঙ্কমুক্ত করার আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচি।

হিপোক্রেসি আমাদের ডিএনতে ঢুকে গেছে। বাইরে আমরা যেটা দেখাই, ভিতরে আমরা কেউই সেটা না। একটা হিপোক্রেট জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষটাও।

হাজবেন্ড কোত্থেকে টাকা আনছে সেটা দেখে না স্ত্রী। টাকা আসলেই হলো। বাবার টাকার উৎস নিয়ে কথা বলে না সন্তান। উল্টা খুশি হয়। হাজবেন্ড দুর্নীতি করে স্ত্রীর নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা রাখে। তাতে স্ত্রীও খুশি। খুব সুন্দর ভরপুর সংসার। বাবার টাকায় দামী গাড়ি হাঁকিয়ে সন্তানরা বাইরে ঘুরে। এরচেয়ে ভালো জীবন আর কি হতে পারে!

পঁচন মাথা থেকে শুরু হয়ে লেজে যায়, নাকি লেজ থেকে শুরু হয়ে মাথায় পৌঁছে জানি না। আমাদের পঁচন ধরেছে মাথা লেজ সবদিক থেকেই।
 
শিক্ষক দুর্নীতি করে। ছাত্রও করে। বাবা করে; সন্তান খুশি। স্বামী করে-স্ত্রী হ্যাপি। মসজিদের ইমাম ধর্ষণ করে। মাদ্রাসার হুজুর বলাৎকার করে। মন্ত্রীও করেন, সঙ্গে তার পিয়ন, ড্রাইভার তারাও সাহস পায়। চোর-পুলিশের মাঝে কোনো পার্থক্য অন্তত নৈতিক মাপকাঠিতে নেই। চোরের চাইতে অনেক ক্ষেত্রে বরং পুলিশই বেশি ডেঞ্জারাস। ব্যবসায়ীরা বসে থাকে সুসময়ের জন্য। যখন মানুষ একটু বেকায়দায় পড়ে, তখনই তাদের দাম বাড়িয়ে ব্যবসা করার মৌসুম হয়। সাধারণ জনগণ তাহলে কে? যে কিছুই করে না?
 
এরা কেউ মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেনি। এদের কেউ না কেউ আমরাই। এরা আমরাই। গোটা জাতিই আজ আমরা এভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ আছেন! প্রতিটি ঘটনার দায় আমাদেরও।
 
আমরা পঁচে গেছি। 

আমাদের মগজ পঁচে গেছে। শরীর পঁচেনি, শরীর বেঁচে আছে পঁচা মগজ নিয়ে। শরীরের পঁচনের চেয়ে মগজের পঁচন ভয়াবহ। পঁচা মগজের দুর্গন্ধ নিয়ে শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদেশে। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। কতটা ভয়াবহ। তবে আরো ভয়াবহ সময় সামনে আসছে। 

গন্ধটাতো সবে বের হতে শুরু করেছে। গন্ধটা সবে পেতে শুরু করেছি আমরা।

আর বেশিদিন নেই, নিজেদের মগজ পঁচা গন্ধে নিজেরাই টিকতে পারবো না আমরা।


লেখকঃ তাওহিদ মিলটন, ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর গ্রে অ্যাডভারটাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড।